নিহত অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেন

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কু‌য়েট) শিক্ষক অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) বিকেল ৫টায় তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. কাজী সাজ্জাদ হোসেনের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন কমিটির সদস্যরা। 

কুয়েটের জনসংযোগ ও তথ্য শাখার মুখপাত্র রবিউল ইসলাম সোহাগ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আজ বিকেলে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ৪৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদনের সঙ্গে ১৩টি সংযুক্তিও রয়েছে।

তদন্ত কমিটির সভাপতি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ, সদস্য গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. আলহাজ উদ্দিন, কুয়েটের অধ্যাপক ড. খন্দকার মাহবুব, বহিঃসদস্য খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর) শাহাবুদ্দীন আহমেদ, খুলনা জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেবাশীষ বসাক উপাচার্যের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

কুয়েট সূত্রে জানা যায়, পাঁচ সদস্যের গঠিত তদন্ত কমিটির মঙ্গলবার রিপোর্ট জমা দেওয়ার দিন ধার্য ছিল। গত ১৩ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাপক সেলিমের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনে এই কমিটি গঠন করা হয়।

তদন্তে ঘটনার সিসি টিভির ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শী ও পরোক্ষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক, ছাত্র ও অন্যান্যদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে পরে সিন্ডিকেট সভায় তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে গত ৩ ডিসেম্বরের সিন্ডিকেট সভায় ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুয়েট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ওই দিন বিকেল ৪টার মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ পেয়ে সাতটি হলে থাকা প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী হল ছাড়েন।

গত ৩০ নভেম্বর বিকেলে মারা যান অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, লালনশাহ হলের ডিসেম্বর মাসের খাদ্য ব্যবস্থাপক (ডাইনিং ম্যানেজার) নির্বাচন নিয়ে ড. সেলিমকে চাপ দিয়ে আসছিলেন ফজলুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটনার দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বাধীন কয়েকজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের রাস্তায় ড. সেলিমকে জেরা শুরু করেন। পরে তারা শিক্ষককে অনুসরণ করে তার ব্যক্তিগত কক্ষে (তড়িৎ প্রকৌশল ভবন) প্রবেশ করেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তারা আনুমানিক আধা ঘণ্টা তার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।

ব্যক্তিগত কক্ষ থেকে বেরিয়ে ড. সেলিম দুপুরের খাবার খেতে ক্যাম্পাস থেকে নিজ বাসায় যান। দুপুর আড়াইটার দিকে তার স্ত্রী লক্ষ্য করেন তিনি বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

অভিযোগ ওঠে, দাফতরিক কক্ষে কুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বে কিছু সাধারণ ছাত্রের জেরা, অপমান, অবরুদ্ধ করে রাখা ও মানসিক নির্যাতনে ড. সেলিমের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনা তদন্তে দুই দফায় কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

ড. সেলিমের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবিসহ পাঁচ দফা দাবিতে ২ ডিসেম্বর দুপুরে একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করে শিক্ষক সমিতি। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান শিক্ষকরা।
 
ড. সেলিমের ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুর ঘটনায় ৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানসহ ৯ শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। নতুন করে গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের নতুন তদন্ত কমিটি। কমিটিকে ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করতে বলা হয়। কিন্তু কমিটি ওই সময়ের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে পারেনি।  গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৮তম জরুরি সিন্ডিকেট সভায় ৫ কর্মদিবসে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। ওই সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ৭ জানুয়ারি খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে ৯ জানুয়ারি থেকে ক্লাস শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর রাতে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় কুয়েট বন্ধের মেয়াদ ১০ দিন বাড়িয়ে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছিল। আজ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলো। 

মোহাম্মদ মিলন/আরএআর