২০২১ সালেও করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত ছিল গোটা বিশ্ব। বাদ যায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। ২০২১ সালে ঢাবির সবচেয়ে স্বস্তির খবর দীর্ঘ ১৯ মাস পর ক্যাম্পাসে ফিরেছেন শিক্ষার্থীরা। বিদায় নেওয়া বছরজুড়ে বিভিন্ন বিষয়ে ঢাবি ছিল আলোচনায়।

প্রথমবারের মতো বিভাগীয় শহরে ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা, শতবর্ষ উদযাপন, শিক্ষার্থীদের ‌‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’, শিক্ষার্থী নির্যাতন, বহিষ্কার, মাদকবিরোধী অভিযানসহ নানা ঘটনা ছিল আলোচনার তুঙ্গে। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো তুলে ধরা হলো সালতামামির এই আয়োজনে।

১৯ মাস পর ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা

দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে ২০২০ সালের মার্চে অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঢাবি কর্তৃপক্ষ শ্রেণি কার্যক্রম ও আবাসিক হল বন্ধ করে। এরপর অনলাইনেই চলে ক্লাস ও পরীক্ষা। করোনা সংক্রমণের হার কমায় গেল বছর হল-ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে সরব ছিলেন শিক্ষার্থীরা। তালা ভেঙে হলে প্রবেশের মতো ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ ঢাবির একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের এক ডোজ টিকা নেওয়ার শর্তে ৫ অক্টোবর খুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিকহলগুলো। এছাড়া একই শর্তে ১৭ অক্টোবর থেকে শুরু হয় সশরীরে ক্লাসও।

দীর্ঘদিন পর সেই লাল বাসে আবারও স্বপ্নিল ক্যাম্পাসে, ঠিক ৮টায় ক্লাস ধরতে হল থেকে তাড়াহুড়োর দৌড়; ক্লাসের ফাঁকে বটতলা, শ্যাডো কিংবা টিএসসিতে একটু চায়ের আড্ডা, গান-গল্প আর গ্রুপ স্টাডির দিনগুলোতে আবার ফিরতে ফেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

প্রথমবারের মতো বিভাগীয় শহরে ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা

করোনা পরিস্থিতি, শিক্ষার্থীদের অর্থ ও সময় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো ঢাকা এবং বিভাগীয় সাতটি শহরে অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। করোনার কারণে বিলম্বিত ২০২০-২১ সেশনের এই ভর্তি পরীক্ষা ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে চলে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি), বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

শতবর্ষ উদযাপন

১৯২১ সালে যাত্রা শুরু করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ বছর পূর্ণ করে ২০২১ সালের ১ জুলাই। কিন্তু করোনার কারণে শতবর্ষের এই অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হয় ডিসেম্বরে। গেল ১ ডিসেম্বর ‘শতবর্ষের আলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামে শুরু হওয়া শতবর্ষপূর্তি উদযাপনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ।

শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ক্যাম্পাসে অপরূপ সাজে সাজানোর পাশাপাশি বেশ কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল আলোচনা সভা, যেখানে অংশ নিয়েছিল দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। ছিল দেশের শীর্ষ শিল্পীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করতে আয়োজন করা হয়েছিল বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের।

শিক্ষার্থী বহিষ্কার

ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকায় গেল বছর ৯ শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কার করেছে ঢাবির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন ও আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ২০০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে।

স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীরা হলেন- পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের মাকসুদুর রহমান, আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের রিজন আহমেদ, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের আয়েশা আক্তার তামান্না, ফিন্যান্স বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শাহ মেহেদী হাসান, ইতিহাস বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের মুহাইমিনুল ইসলাম, দর্শন বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের আশরাফুল আলম, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষের মো. শাহেদ আহমেদ, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের মো. রাকিব হাসান ও ভূতত্ত্ব বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ইশরাক হোসেন রাফি।

মোদির আগমন ইস্যুতে রণক্ষেত্র ঢাবি

গেল বছর নরেন্দ্র মোদির আগমনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঢাবি ক্যাম্পাস যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। মোদির পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বাম সংগঠন ও ছাত্রলীগের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ছাত্রলীগের অতর্কিত হামলায় আহত হয়েছিলেন বাম সংগঠনের অর্ধ-শতাধিক নেতাকর্মীসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। এছাড়া মোদির আগমনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সরব ছিল ছাত্র অধিকার পরিষদও। ওই সময় ক্যাম্পাসে এক ধরণের থমথমে অবস্থা বিরাজ করেছিল।

বিশেষ করে গত ২৫ মার্চ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বর ও দক্ষিণ ফুলার রোডে অবস্থিত শিক্ষক কোয়ার্টারের সামনে ছাত্রলীগের অতর্কিত হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন বাম সংগঠনের বেশ কিছু নেতাকর্মী এবং প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আসিফ হাওলাদার। ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানও হামলার সম্মুখে পড়ে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

মাদক বিরোধী অভিযান, আটক অর্ধ-শতাধিক

করোনার কারণে বন্ধ থাকা ক্যাম্পাসে যেন হয়ে উঠেছিল মাদকসেবীদের আখড়া। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মৃত্যুতে বিষাক্ত মাদক এলএসডির যোগসূত্র পাওয়ায় ক্যাম্পাসে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে মাদকমুক্ত রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অন্তত ৮টি মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে ঢাবি প্রশাসন। এসব অভিযানে প্রায় অর্ধশত মাদকসেবী ও মাদকের ডিলারদের আটক করে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়েছিল। যাদের মধ্যে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবার অনেকে বহিরাগত।

তিন শিক্ষার্থীর ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু

চলতি বছর ঢাবির অন্তত তিনজন শিক্ষার্থীর ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অন্যতম ঢাবির তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মৃত্যু। নিখোঁজের ৯ দিন পরে হাসপাতালের মর্গে মেলে তার লাশ। এতে তার চার বন্ধুকে সন্দেহ ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান শোক প্রকাশ করেছিলেন। একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল যদিও সে রিপোর্ট এখনো পর্যন্ত দিতে পারেনি কমিটি।

এছাড়া গত ৬ জুন রাজধানীর পলাশী সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের একটি বাসার বাথরুম থেকে উদ্ধার করা হয় ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান তুষ্টির মরদেহ। তার মৃত্যু অস্বাভাবিক উল্লেখ করে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছিল পরিবার। সর্বশেষ নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী এলমা চৌধুরী মেঘলার মৃত্যুকে ‘হত্যা’ দাবিতে ফুঁসে উঠেছিল বিভাগের শিক্ষক-সহপাঠীরা। এই ঘটনায় মামলা করা হয়েছে এবং প্রধান অভিযুক্ত মেঘলার স্বামী ইফতেখারকে আটক করা হয়েছে। মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। এছাড়া প্রশ্ন উঠেছিল গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহাদী অপুর মৃত্যুতেও।

এসব মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এসব ঘটনায় দ্রুত সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি জানিয়েছেন।

শিক্ষার্থী নির্যাতন ও বহিষ্কার

ক্যাম্পাস খোলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে বেশ কয়েকটি নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। গত বছরের ৯ অক্টোবর শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ছাত্রদল ও ছাত্র ইউনিয়নের দুই কর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এর কয়েকদিন পর বড় ভাইদের সালাম না দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে প্রথম বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে। এছাড়া ২০ নভেম্বর ফেসবুকে পোস্টের জেরে স্যার এ এফ রহমান হলের পাঁচজন শিক্ষার্থীকেও নির্যাতন করা হয়।

সর্বশেষ গত ২০ ডিসেম্বর মো. সিফাতুল্লাহ সিফাত নামে এক শিক্ষার্থীকে ঢাবির মাস্টারদা সূর্য সেন হল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে হল প্রশাসন। তার বিরুদ্ধে হলের আরেক শিক্ষার্থী কাজী পরশ মিয়াকে নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

প্রচলিত আইন ভেঙে বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকার সুযোগ

গেল বছরের শেষ দিকে আলোচনার শীর্ষে ছিল ‘বিবাহিত ছাত্রীরা হলে থাকতে পারবেন না’— ঢাবির ছাত্রী হলগুলোর আসন বণ্টনবিষয়ক নীতিমালায় থাকা প্রচলিত এ নিয়মটি। এই নিয়ম নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা চলছিল। নিয়মটি বাতিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির ঢাবি কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ২২ ডিসেম্বর এই নিয়মটি বাতিল করেছে প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি। এখন থেকে বিবাহিত শিক্ষার্থীদের হলে থাকাতে আর কোনো বাধা নেই।

এইচআর/ওএফ