একটি বিদ্যাপীঠ। তার কাঁধে কত বোঝা বয়ে বেড়ায়! কত শত স্মৃতির বোঝা!  হাজারও শিক্ষার্থীর পদভার সে সহ্য করে। আবার, ছুটির দিনগুলোতে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি তাকে করে দেয় প্রাণহীন।

এইতো, এই ছেলেটিই তো কিছুদিন আগে তার বাবার হাত ধরে স্কুলে এসেছিল, তখন তার কাঁধে ব্যাগ ছিল। আজ আবারও সে এখানে এসেছেন, তবে একজন শিক্ষার্থী হয়ে নয়, বাবা হয়ে।

ঐ যে লোকটি যাচ্ছেন, উনি এখানকার অংকের শিক্ষক। তিনি যেদিন প্রথম এখানে এসেছিলেন, সেদিন তার মাথায় ঘন কালো চুল ছিল, চেহারায় লাবণ্য ছিল। সেই রোগা শিক্ষক কিছুদিনের ব্যবধানেই কেমন বৃদ্ধ হয়ে গেল। মাথায় আঁধা পাকা চুল কিছুমাত্র অবশিষ্ট আছে, চোখে বসেছে চশমা, গায়ের চামরায় ভাজ পড়েছে, নানান অসুখে জর্জরিত সে।

কোনো এক শিক্ষকের বেতের আঘাত ছেলেগুলোকে বার বার কাঁদিয়েছে, আজ তারই জানাজায় দাড়িয়ে ছেলেগুলো আবার কাঁদছে। 

ঐ যে! ঐ জায়গায় একটা টুলে বসে থাকতেন রমজান মামা। ছুটির ঘণ্টা পরার আগে স্কুল থেকে বের হওয়ার আবদার জানালে, আমাদের দিকে চোখ রাঙিয়ে কড়া কন্ঠে বলতেন, " এহন গেট খোলা যাইবো না, এহোনো ঘণ্টা পরতে মেলা দেরি আছে"। আজ সেই জায়গাটাও আছে আর টুল টাও আছে কিন্তু রমজান মামা আর নেই।

এই মাঠেই কোনো এক সুসজ্জিত প্যান্ডেলে শিক্ষার্থীরা আনন্দে মেতেছে তাদের নবীন বরণে। আবার, এমনই এক প্যান্ডেলে বসে বন্ধুরা গলা জড়িয়ে কেঁদেছে বিদায় অনুষ্ঠানে।

যেই ম্যাডাম ক্লাসে এসে রোজ বলত, "তোমাদের মতো বাজে ব্যাচ আর একটাও ছিলনা"। তিনিই আবার পরের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সামনে গর্ব করে বলেন, "তোমাদের আগের ব্যাচের সবাই খুব ভালো ছিল। তোমাদের মতো এত ফাকিবাজ ছিলনা ওরা।"

সেই ক্যান্টিন এখনো আছে। খাবার কিনতে এখনো লম্বা লাইন হয় তবে, মুখগুলো আলাদা। এই প্রাঙ্গণে এখনো নিয়ম করে প্রতিদিন জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে ওঠে হাজারো শিক্ষার্থী। সুর একই আছে, পাল্টে গেছে কণ্ঠস্বর। 

ক্লাস এর যেই ছেলেটা পড়াশুনার চাপে বিরক্ত হয়ে স্কুল জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা ভাবত, আজ সংসারের নানান হিসেবের চাপে পরাস্ত হয়ে সে আবার ফিরে যেতে চায় স্কুল জীবনের সেই রঙিন দিনগুলোতে।

ছুটির ঘণ্টার অপেক্ষায় বার বার ঘড়ি দেখা ছাত্রগুলো একসময়  স্কুল থেকে একেবারে ছুটি পেয়ে যায়। কোনো একদিন পুরোনো স্কুলটাতে গেলে আবারও বেজে ওঠে সেই ঘণ্টা কিন্তু এই ঘণ্টা আর তাকে ডাকে না। অনেক সময় পেড়িয়ে  গেছে। যা নেয়ার ছিল তার সবকিছুই সে নিয়ে গেছে, শুধু রেখে গেছে স্মৃতি।

বিদ্যালয়গুলো এমন করেই স্থির রবে চিরকাল। মাঠ হয়ত বড় থেকে ছোট হবে, একটা ভবনের পাশে আরেকটা ভবন উঠবে, বয়স ঢাকার জন্য হয়ত ঘসে-মেজে দেয়ালগুলো রঙিন করা হবে, তবুও বিদ্যালয়গুলো স্থির রবে চিরকাল। নিজের জায়গায় অটল থেকে বহন করবে শত শত বছরের স্মৃতি। বহন করবে অসংখ্য শিক্ষার্থীর শৈশব-কৈশর, বহন করবে শত শিক্ষকের যৌবন থেকে বার্ধক্য। বহন করবে কারো কারো আলোকিত জীবনের সুনাম আবার কারো ব্যর্থতার চিহ্ন। 

তবু মাথা উচু করে আপন স্থানে স্থির হয়ে রবে যুগ যুগ। স্থির রবে সকল শিক্ষার্থীদের মনে।

আরআর