সাদ্দামের পথে হাঁটছেন সাতক্ষীরার তরুণ-তরুণীরা
৪ বছর আগে মাশরুম চাষ শুরু করেছিলেন সাতক্ষীরার সাদ্দাম হোসেন। শহরের পারকুকরালী কাঁঠালতলা এলাকায় গড়ে তুলেছেন কসমিক মাশরুম পয়েন্ট নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখন তার দেখানো পথে হাঁটছেন সাতক্ষীরার অনেক তরুণ-তরুণী।
একটা সময় মাশরুমের ক্রেতা সংকট থাকলেও এখন সরবরাহ করতেই হিমশিম খাচ্ছেন সাদ্দাম। কৃষি বিভাগ বলছে, মাশরুম ঔষধিগুণ সম্পন্ন একটি ভেষজ সবজি। এতে রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করায় মাশরুমে আগ্রহ বাড়ছে তরুণ-তরুণীদের।
বিজ্ঞাপন
সাদ্দাম হোসেন সাতক্ষীরা শহরের পারকুকরালী গ্রামের কৃষক আব্দুল হাকিম সানার ছেলে। সাতক্ষীরা সিটি কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স শেষ করেছেন। তার গড়ে তোলা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কসমিক মাশরুম পয়েন্ট থেকে এখন প্রতি মাসে আয় হচ্ছে ৩০-৩৫ হাজার টাকা। তরুণ-তরুণীদের দিচ্ছেন প্রশিক্ষণও।
বিজ্ঞাপন
সাদ্দাম হোসেন বলেন, শুরুটা ছিল ২০১৮ সালে। তখন সাতক্ষীরার মানুষদের মাশরুম সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল না। মাশরুম খাওয়ার উপকারিতা বিষয়েও জানত না। তবে এখন সাতক্ষীরায় মাশরুমের একটি মার্কেট তৈরি হয়েছে। ক্রেতারা মাশরুম কিনছে। প্রতিদিন ১৫-২০ কেজি মাশরুম বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। জেলায় ২০-২৫ জন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। যারা এখন মাশরুম চাষ ও ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের শুরুর দিকে কসমিক মাশরুম পয়েন্ট নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। শুরুর পরই মহামারি করোনা হানা দেয় দেশে। এরপর দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কার্যক্রম চালিয়েছি। বর্তমানে খামারে দুই হাজার ব্যাগ মাশরুমের প্যাকেট রয়েছে। যেখান থেকে প্রতি সপ্তাহে ৬০ কেজি মাশরুম উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি মাশরুম বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। শুকনা মাশরুম প্রতি কেজি আড়াই হাজার ও গুড়া মাশরুম বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার টাকায়।
সাতক্ষীরার নগরঘাটা গ্রামের সাধন সরকারের মেয়ে অজ্ঞনা সরকার। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে ২০১৪ সালে ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির আবেদন করলে মেলেনি চাকরি। অবশেষে ২০২০ সাল থেকে মাশরুম চাষ শুরু করেন তিনি। সাতক্ষীরার সরকারি কলেজের পাশে মেসে করছেন মাশরুম চাষ।
অজ্ঞনা সরকার জানান, শতাধিক আবেদন করেও কোনো চাকরি মেলেনি। এরপর সাদ্দাম ভাইয়ের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাশরুম চাষ শুরু করি। মেসে রুমের মধ্যে ১০০ প্যাকেট মাশরুম চাষ করেছি। মাশরুম বিক্রি করে সেখান থেকে প্রতি মাসে ১২-১৪ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। সেটি দিয়েই নিজের খরচ চালাচ্ছি। খুচরা ক্রেতাদের কাছে প্রতি কেজি মাশরুম ৩০০ টাকায় বিক্রি করি। ফোনে অর্ডার করে ক্রেতারা। আমি হোম ডেলিভারি দিয়ে আসি। এখন আর চাকরির পেছনে দৌঁড়ায় না।
সাতক্ষীরা জেলা খামারবাড়ি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে মাশরুম চাষ করছেন ৫০ জন। এর মধ্যে দুইজন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন। এদের বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
অল্প পুঁজিতে অধিক লাভের আশায় নতুনভাবে মাশুরুমের চাষ শুরু করেছেন শহরের কুকরালি গ্রামের রাজু আহম্মেদ। তিনি জানান, ১২ হাজার প্যাকেট দিয়ে মাশরুম চাষ শুরু করেছি। উৎপাদন শুরু হলে প্রতিদিন ৫০০ থেকে এক হাজার কেজি মাশরুম উৎপাদন হবে। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হবে। সেভাবেই সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি।
সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল এলাকার আমিনুর রহমানের ছেলে আব্দুল করিমও এখন মাশরুমচাষি। তিনি জানান, আমি সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে লেখাপড়া করছি। আড়াই থেকে তিন বছর আগে মাশরুম চাষের সঙ্গে জড়িয়েছি। এখন প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা রোজগার হচ্ছে। বাড়ির নিচে ৫০০ প্যাকেটে মাশরুম চাষ করেছি। সেখান থেকে উৎপাদিত মাশরুম দিনে ৫-৭ কেজি বিক্রি করছি। চিকিৎসক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনজীবী ও ব্যাংকার শ্রেণির ক্রেতা বেশি।
এই কলেজছাত্র জানান, প্রতি কেজি কাঁচা মাশরুম ৩০০ টাকা, শুকনা মাশরুম আড়াই হাজার টাকা ও গুড়া মাশরুম প্রতি কেজি বিক্রি হয় তিন হাজার টাকায়। ৫০০ প্যাকেট মাশরুম চাষ করতে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। সেখান থেকে রোজগার হয় ৩২-৩৫ হাজার টাকা। বীজ লাগানোর ৩-৪ দিনের মধ্যেই ফুল আসা শুরু করে এবং ৭ দিনের মধ্যেই বিক্রি উপযোগী হয়। একবার বীজ লাগালে দুই মাস পর্যন্ত ফলন দেয়। পরবর্তীতে আবারও নতুনভাবে মাশরুম বীজ বপন করতে হয়। বেকার যুবকরাও মাশরুম চাষ করে নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারে।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, মাশরুম একটি পুষ্টিকর ভেষজ সবজি। মাশরুম থেকে ৩০-৩৫ ধরনের রোগ নিরাময় হয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা ডায়বেটিস, হার্টের সমস্যায় ভুগছেন তারা এটি খেলে ভালো উপকার পাবেন। আমরা মাশরুমের ওপরে অনেক চাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সাতক্ষীরায় এখন পারিবারিকভাবে ৫০-৬০ জন মাশরুম চাষ করছেন। এছাড়া দুইজন বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম উৎপাদন করছেন।
তিনি বলেন, মাশরুম চাষ করে চাষিরা পুষ্টিকর খাবার হিসেবে নিজেরাও খেতে পারছে আবার অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হচ্ছেন। দিন দিন সাতক্ষীরায় এটি সম্প্রসারণ হচ্ছে। অনেক তরুণ-তরুণী মাশরুম চাষের প্রতি ঝুঁকছেন।
আকরামুল ইসলাম/এসপি