ঘটনার সূত্রপাত গত বুধবার। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) ক্যাম্পাসে মানববন্ধনের আয়োজন করে একদল শিক্ষার্থী। সেখানে অভিযোগ তোলা হয়, কলেজের ম-৫৩ ব্যাচের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেছেন সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ। 

ঘটনাটি গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পাল্টা ক্ষোভ ছড়ায় ওই ব্যাচের সাধারণ শিক্ষার্থী এবং কলেজের শিক্ষকদের মাঝে। তাদের দাবি, এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এমনকী এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি ভুক্তভোগী ছাত্রীকে। 

ম-৫৩ ব্যাচের এক ছাত্রী বলেন, আমাদের ব্যাচের মেয়েকে নিয়ে কথা উঠেছে। কিন্তু এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ব্যক্তিগতভাবে আমরা একজন একজন করে সবার সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু এমন কোনো মেয়ে নেই আমাদের মধ্যে যে কীনা যৌন হয়রানির শিকার হয়ে হোস্টেল ছেড়ে চলে গেছে। এমন যদি হতো তাহলে তো আমরা অবশ্যই জানতাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে এ রকম কেউ নেই।  

আরেক ছাত্রী বলেন, আমরা যেমন নিজের বাবা সম্পর্কে এমন কোনো চিন্তা করতে পারি না। তেমনি আমাদের স্যার সম্পর্কেও এমন চিন্তা করতে পারি না। আমাদের মতো দিনের আলোর মতই স্পষ্ট যে এ কাজটি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে করা হয়েছে। আমাদের সিনিয়র কিংবা জুনিয়র ব্যাচ থেকে কখনই এমন কোনো অভিযোগ আসেনি। ব্যক্তি স্বার্থে স্যারের বিরুদ্ধে এমন সম্মানহানিকর অভিযোগ এনে গুটি কয়েক শিক্ষার্থী দিয়ে ওই মানববন্ধনটি করানো হয়েছে। 

যৌন হয়রানির মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এমন ধোঁয়াশা তৈরি হলে অনুসন্ধানে নামে ঢাকা পোস্ট। প্রথমে অভিযুক্ত শিক্ষকের কাছেই জানতে চাওয়া হয় কেন তাহলে সেই মানববন্ধন?  

তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে কেন এ কাজটি করেছে এটি তা আমি জানি না। তবে ঘটনার একটি যোগসূত্র থাকতে পারে। গত প্রফেশনাল ফাইনাল পরীক্ষায় কিছু ছাত্র খারাপ করেছে। যেহেতু তারা মানসম্পন্ন ছিল না তাই তারা খারাপ করেছে। তাদের ভেতর কোনো ক্ষোভ থাকতে পার। আমার ধারণা ফলাফল খারাপের সঙ্গে এই মানববন্ধনের একটি যোগসূত্র থাকতে পারে। 

তিনি আরো বলেন, তারা মনে করছে যেহেতু পড়াশোনা করেনি ওই অবস্থায় আমি যদি থাকি তাহলে তাদের ডাক্তার হওয়া হবে না। এটা ওদের ভুল ধারণা। আমি শিক্ষক, ওদের পড়াশোনা করিয়েই ডাক্তার বানাব। অনেকেই দুই-তিনবার পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তার হয়। ডাক্তার হতে হলে যোগ্যতা দিয়েই ডাক্তার হতে হবে। 

যারা ওই মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়েছে তাদেরকে পথভ্রষ্ট হিসেবে উল্লেখ করে এ অধ্যাপক আরো বলেন, তারা রাজনীতির একটি ব্যানার ব্যবহার করলেও আমার দৃষ্টিতে তারা পথভ্রষ্ট, দিশেহারা কিছু ছেলে-পেলে যারা পড়াশোনা করেনি।  

বিভাগীয় প্রধানের কথার সূত্র ধরেই গত ১২ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষার হলের একটি ঘটনা নিয়ে জানতে চাওয়া হয় সেইদিন ওই হলে উপস্থিত থাকা চিকিৎসকদের কাছে। সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. মোহাম্মদ সাইফুল মালেক বলেন, যখন পরীক্ষা চলছিল সেই পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে একটি মিছিল আসে পরীক্ষার হল পর্যন্ত। পরে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক তাদের সঙ্গে কথা বলে নিচে পাঠিয়ে দেয়। হয়তো কারো কোনো প্রভাব দেখাতেই পরীক্ষার হল পর্যন্ত মিছিলটি নিয়ে যাওয়া হয়। 

একই বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. নাজিয়া ইসলাম, আমরা কখনো শুনিনি কিংবা দেখিনি যে পরীক্ষার হলে কেউ কখনো মিছিল নিয়ে যেতে। কারা করেছে তা সবাই দেখেছে। সিসিটিভি ফুটেজেও তা আছে। সুতরাং তারা কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই এ কাজটি করেছে। হয়তো শিক্ষকদের প্রতি চাপ প্রয়োগ করতেই এমনটি করা হতে পারে। 

অর্থাৎ অভিযোগের তীর ৫৩ ব্যাচের ছাত্র ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল হাসানের দিকে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালে এমবিবিএস ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষায় মেডিসিন বিষয়ে পাস করলেও গাইনি ও সার্জারি বিষয়ে ফেল করে হাসান। এ কারণে চলতি মাসে ফের বসতে হয় পরীক্ষার হলে।  

একাধিক শিক্ষক জানান, সার্জারি বিভাগীয় প্রধান কারো চাপকেই গ্রাহ্য করেন না। রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে তার কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা সম্ভব নয়। তাই তার বিরুদ্ধ কুৎসা রটিয়ে তাকে হেয় করার মাধ্যমে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে একটি সিন্ডিকেট।  

অনেকটা এর প্রমাণ মিলল কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলেই। মমেক অধ্যক্ষ চিত্তরঞ্জন দেবনাথ জানান, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ফেল করানো হবে উল্লেখ করে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসান ৫৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিভাগীয় প্রধান আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয় পরীক্ষার পরদিন। এরপর একই গত বুধবার ওই ৫৩ ব্যাচের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে মানববন্ধন করে কিছু শিক্ষার্থী। 

যদিও এমন কোনো লিখিত অভিযোগ তিনি পাননি জানিয়ে অধ্যক্ষ বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। তবে এ ব্যাপারটা নিয়ে যেহেতু মানববন্ধন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ হয়েছে এ জন্য গাইনী বিভাগের অধ্যাপক তায়েবা তানজিন মির্জাকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। 

এ বিষয়ে কথা বলতে মমেক শাখা ছাত্রলীগে সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল হাসানের সাথে কথা বলতে ঘটনার পরদিন গত বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) থেকে রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় কল করা হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর মেলেনি। 

তবে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি অনুপম সাহা জানিয়েছেন, ব্যাপারটি নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। 

এদিকে মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে পরীক্ষায় পাসের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন শিক্ষকরা। দিয়েছেন ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম। এ সময়টাতে বন্ধ থাকবে তাদের পাঠদান। 

এদিকে শিক্ষকদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে অধ্যক্ষ বরাবর স্মারণলিপি দিয়েছেন ম-৫৩ ব্যাচের সকল শিক্ষার্থী। স্মারকলিপিতে তারা উল্লেখ করেন, এমন এক ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে যেই হয়রানির অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সব ধরনের সদাচারের পরিপন্থী এবং সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট। এ অভিযোগের সঙ্গে আমাদের ব্যাচ এর নাম যুক্ত হওয়ায় আমরা হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। তার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও সত্যের পথে অনঢ় থাকার জন্য কিছু কুচক্রী মহল তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এনেছে বলে আমাদের ধারণা। 

সেখানে আরো উল্লেখ করেন, কথিত সেই মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউই ম-৫৩ ব্যাচের ছিল না এবং এই ব্যাপারে ম-৫৩ ব্যাচের কেউ অবগত নয়। 

এ ব্যাপারে উপযুক্ত কোনো প্রমাণের অস্তিত্ব না থাকার পরও কুচক্রী মহল এই ব্যাপারে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য একজন বিশিষ্ট অধ্যাপকের সামাজিক সম্মানহানি হচ্ছে। 

এ ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপপ্রচারকারীদের খুঁজে বের করা এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সম্মান ক্ষুণ্ন এববং যথাযথ শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা সোচ্চার দাবি জানাচ্ছি।

এমএএস