প্রতিদিন অর্ধশতাধিক রোগী দেখেন হাত-পা হারানো জব্বার
১৪ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের একটি কক্ষ। চারপাশে ইটের দেয়াল, ওপরে টিনের চাল। কক্ষটির ভেতরে তিনটি কাঠের আলমারি। সেখানে সারিবদ্ধভাবে থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। দোকানে গদিযুক্ত একটি ফোমের চেয়ারে বসে আছেন প্রবীণ এক ব্যক্তি। তার পাশে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা মধ্যবয়সী এক নারী।
ফোমের চেয়ারে বসা ব্যক্তিটির নাম জব্বার হাওলাদার (৫৯)। এলাকার সবাই তাকে জব্বার ডাক্তার (পল্লী চিকিৎসক) হিসেবে চেনেন। পাশের প্লাস্টিকের চেয়ারে যে নারী বসা তার নাম হেলেনা বেগম (৫২)। তিনি জব্বারের স্ত্রী।
বিজ্ঞাপন
তবে জব্বার হাওলাদার আর দশজনের স্বাভাবিক সুস্থ নন। তার দুই হাত কনুই থেকে ও দুই পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। গ্যাংরিন (পচনশীল ক্ষত) রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ২১ বার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রথমে বাম পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে শুরু করে কাটতে কাটতে হাঁটু থেকে দুই পা এবং পরবর্তীতে কনুই থেকে দুই হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। হাত-পা না থাকলেও তিনি জীবন সংগ্রামে থেমে নেই। পল্লী চিকিৎসক হিসেবে এলাকার মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, ফরিদপুর শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ভাঙ্গা সদর চৌরাস্তা। সেখানে থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ১৬ কিলোমিটার গেলে পুলিয়া বাজার। পুলিয়া বাজার থেকে দক্ষিণে অটোরিকশায় চার কিলোমিটার গেলে ভাঙ্গার আজিমনগর ইউনিয়নের শিমুলবাজার। শিমুলবাজারে বিভিন্ন পণ্যের তিন শতাধিক দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ওষুধের দোকান রয়েছে অন্তত ১০টি । এর মধ্যে একটি ওষুধের দোকানের নাম আল-আমিন ফার্মেসি। ওই ওষুধের দোকানটি জব্বারের।
বিজ্ঞাপন
এ অঞ্চলের লোকের জ্বর, ঠান্ডা, হাঁচি-কাশি, এলার্জিজনিত ছোটখাট সমস্যা, পেটের পীড়া বা মাথা ব্যথাসহ ছোটখাটো সকল রোগের সমাধান মেলে আল-আমিন ফার্মেসিতে গেলে। সেখানে ওষুধের ব্যবস্থাপত্রের জন্য কোনো টাকা নেন না জব্বার। পাশাপাশি ওষুধও ওই ফার্মেসি থেকেই কেনা যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আজিমনগর ইউনিয়নের কররা গ্রামের ময়েজ হাওলাদের চার ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে জব্বার সবার বড়। ১৯৮৪ সালে স্থানীয় পুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ১৯৮৫ সালে ২২ বছর বয়সে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার চন্দ্রিবরদী গ্রামের হেলেনা বেগমকে বিয়ে করেন। ১৯৮৬ সালে ছোট ভাই জলিল হাওলাদারের পাখি রাখার খাঁচা বানাতে বাঁশ কাটতে গিয়ে অসাবধানতাবসত বাম পায়ের বৃদ্ধা আঙুলে দায়ের কোপ লেগে সামান্য কেটে যায়। পরে ইনফেকশন দেখা দেয়।
ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে (বর্তমানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) চিকিৎসক দেখানো হলে তাকে খাওয়ার জন্য কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। এতেও তার গ্যাংরিন সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ১৯৮৭ সালে বাম পায়ের বৃদ্ধা আঙুলসহ দুটি আঙুল কেটে ফেলতে হয়। এই অস্ত্রোপচার করা হয় ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে। তবে সংক্রমণ এখানেই থেমে যায়নি। পায়ের দুটি আঙুল হারিয়ে এলাকায় এসে টিউশনিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন জব্বার। এলাকায় ভালো ছাত্র হিসেবে তার সুনাম থাকায় তার টিউশনির প্রসার ঘটতে থাকে। পুলিয়া, কররা, জাঙ্গালপাশাসহ আশপাশের পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদেরকে প্রাইভেট পড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন তিনি। পাশাপাশি তার গ্যাংরিনের সংক্রমণ বাড়তেই থাকে।
১৯৮৮ সাল থেকে একের পর এক পায়ের বিভিন্ন আঙুলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। অস্ত্রোপচার করা সেই আঙুল গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয়। এভাবেই একের পর এক অস্ত্রোপচারে একটা দুইটা করে পায়ের আঙুল হারাতে থাকেন জব্বার। এর মধ্যেও তিনি থেমে থাকেননি। প্রাইভেট পড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন।
১৯৯৫ সালের শুরুর দিকে ডান হাতের তর্জনী ও বৃদ্ধা আঙুলে তিনি ঘা দেখতে পান। লেখার জন্য কলম ধরার কারণে ডান হাতের আঙুলের যে দুই অংশে বেশি চাপ লাগে সেখানেই প্রথমে ঘা দেখা দেয়। যা দ্রুত ছড়িয়ে পরে এক আঙুল থেকে অন্য আঙুলে, পায়ের ও হাতের কবজি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। তখন অস্ত্রোপচার করে সেসব আঙুল কেটে ফেলা হয়। এভাবে এক আঙ্গুল থেকে আরেক আঙুল অস্ত্রোপচার করে কাটতে কাটতে ২০ বার অস্ত্রোপচার করেও গ্যাংরিনের সংক্রমণ কমেনি।
পরে ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২১তম অস্ত্রোপচার করে তার দুই পা হাঁটু থেকে এবং দুই হাত কনুই থেকে কেটে ফেলতে হয়। টানা তিন বছর ধরে খেতে হয় ওষুধ। এখন প্রতিবন্ধী হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন জব্বার হাওলাদার।
তিন মেয়ে ও এক ছেলের বাবা জব্বার। ১৯৯৪ সালে তার বড় মেয়ে সাবিনার জন্ম হয়। সাবিনাকে বিয়ে দেন ভাঙ্গার দিঘীরপাড় গ্রামে। ১৯৯৭ সালে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় মেয়ে সোনিয়ার বিয়ে দেন মাদারীপুরের শিবচরের দত্তপাড়া গ্রামে। ছেলে সোহেল রানা বর্তমানে পড়াশোনা করছে নবম শ্রেণিতে। সবার ছোট ছয় বছরের মেয়ে সুবর্ণা আক্তার প্রথম শ্রেণিতে পড়ে শিমুল বাজার কিন্ডার গার্টেন স্কুলে।
জব্বার হাওলাদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তার চিকিৎসায় প্রায় ১৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। হাত-পা হারিয়ে প্রতিবন্ধী হওয়ার পরও তিনি থেমে থাকেননি।
জব্বার ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি কারো মুখের দিকে চেয়ে থাকতে চাননি। সব সময় শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে আত্ম-কর্মসংস্থানের চেষ্টা করেছেন। ১৯৯৯ সালে তিনি পুলিয়া বাজারের রোকন আকন্দের মালিকানাধীন আল-আমিন ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রির কাজ শেখা শুরু করেন। যেখানে তিনি ২০০৯ সাল পর্যন্ত ওষুধের নাম, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। এর ভেতরেই ২০০২ সালে তিনি ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার লোকাল হেলথ অ্যান্ড পিপলস ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি থেকে ছয় মাস মেয়াদি এলএমএএফ (লোকাল মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি) পাস করেন।
রোকন আকন্দ ওষুধের ব্যবসা ছেড়ে দিলে তার ওই ড্রাগ লাইসেন্স নিজের নামে এফিডেভিট করে ২০০৯ সালেই নিজের এই ওষুধের দোকান শুরু করেন জব্বার। ২০১১ সালে ফরিদপুর সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের অধীনে তিন মাস মেয়াদি ভিডিআরএমপি (ভিলেজ ডাক্তার রুরাল মেডিকেল প্র্যাকটিশনার) প্রশিক্ষণও নেন তিনি।
এসব কাজে সব সময় ছায়ার মতো পাশে থেকে সার্বিক সহায়তা করেছেন তার স্ত্রী হেলেনা বেগম। ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও বর্তমানে তার দোকানে দেড় লক্ষাধিক টাকার ওষুধ আছে। এই ওষুধের দোকানের লভ্যাংশের টাকা দিয়ে নিজের দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এক তলা বিশিষ্ট পাকা ঘর তোলার কাজ প্রায় শেষ করেছেন। সব মিলিয়ে এখন তিনি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। মানুষকে ফ্রিতে চিকিৎসা দিয়েও এলাকায় হয়েছেন জনপ্রিয়। ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লেখেন পল্লী চিকিৎসক জব্বার আর রোগীদের ওষুধ দেওয়া, প্রেসার মাপাসহ সমস্ত কাজে তাকে সাহায্য করেন স্ত্রী হেলেনা বেগম।
সকাল সাড়ে ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত দুপুরের বিরতির পর বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত রোগী দেখেন জব্বার। এই দুই বেলায় মোট চারবার শিমুলবাজার থেকে এক কিলোমিটার দূরবর্তী কররা গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত ভ্যানে জব্বারকে আনা নেওয়ার কাজ করেন ভ্যানচালক আব্দুল হক। এ কাজের জন্য মাসিক চুক্তিতে ছয় হাজার টাকা দিতে হয়।
জব্বারের স্ত্রী হেলেনা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বামীকে সুস্থ-স্বাভাবিক দেখেই বিয়ে করেছিলাম। রোগের কারণে তিনি আজ প্রতিবন্ধী। ১৯৯৫ সালে আমার স্বামীর দুই পা ও হাত কেটে ফেলার পর থেকে আমাদের অনেক কষ্টের সময় গেছে। স্বামীর চিকিৎসার জন্য চার বিঘা জমিও আমাদের বিক্রি করতে হয়েছে। এরপর এই দোকানটা দেওয়ার পর রোগী বাড়তে থাকে। এখন প্রতিদিন প্রায় ৬০/৭০ জন রোগী এখানে ছোট ছোট বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন। সব মিলিয়ে আমাদের দিন এখন ভালো যাচ্ছে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, বাকি এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ভালো আছি।
আজিমনগরের চকলারপাড় গ্রামের বাসিন্দা কৃষক শাহাবুদ্দিন মাতুব্বর (৭৫) ঢাকা পোস্টকে বলেন, জব্বারের ফার্মেসি এই বাজারে আছে বলে আমাদের ছোটখাটো সমস্যায় ভাঙ্গা কিংবা ফরিদপুর যেতে হয় না। এখানেই আমরা ডায়াবেটিস, প্রেসার মাপাসহ জ্বর, মাথা ব্যথাসহ অনেক রোগের ওষুধ পেয়ে থাকি।
জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা জাঙ্গালপাশা গ্রামের গৃহবধূ আলোমতি বেগম (৩৯) ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন প্রতিবন্ধী মানুষ আমাদের এমন সেবা দিতে পারবে এটা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রথম প্রথম আমরা উনাকে তত গুরুত্ব দেইনি। পরে যখন দেখলাম ওনার দেওয়া ওষুধ খেয়ে সবাই ভালো হচ্ছে, লোকজন ভালো বলছে, তখন আমরা এখানে আসতে লাগলাম।
তিনি বলেন, এখন এই এলাকায় জব্বার হাওলাদার একজন জনপ্রিয় চিকিৎসক। শিশু, নারী ও বৃদ্ধ সবারই সাধারণ রোগের সকল ওষুধ তিনি দিতে পারেন।
পল্লী চিকিৎসক জব্বার হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি প্রতিবন্ধী মানুষ। আমার জীবনে চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। তবে জীবনে অনেক খারাপ সময় গেছে। আমি মনোবল ধরে রেখেছি শক্তভাবে। একটা কথা সব সময় ভেবেছি কোনো অবস্থাতেই মানুষের কাছে হাত পাতবো না। এই আত্মসম্মানবোধ আমার ছিল। এজন্য জীবনে আমার কখনো কারো কাছে হাত পাততেও হয়নি। এখন জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমি বলতে পারি আমি ভালো আছি।
তিনি বলেন, যারা অল্পতেই ভেঙে পড়ে বা সুযোগ পেলেই অন্যের সাহায্য সহযোগিতায় চলতে পছন্দ করে তাদের সম্পর্কে আমি বলতে চাই- আত্মসম্মান জীবনের সবচেয়ে বড় অলংকার। আর মনোবল হলো যেকোনোও খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলার অস্ত্র।
আজিমনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহজাহান হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জব্বার একজন আত্মনির্ভরশীল ব্যক্তি। তার স্ত্রীর সহায়তায় নিজেই নিজেরসহ পরিবারের দায়িত্ব সমানতালে পালন করে যাচ্ছেন। যেখানে তার নিজেই ভিক্ষাবৃত্তি বা অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার কথা ছিল, সেখানে তিনি পরিবারের বটবৃক্ষ হয়ে বেঁচে আছেন। জব্বার ডাক্তার আমাদের জন্য অবশ্যই একজন অনুকরণীয় ব্যক্তি।
ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহসিন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, জব্বার স্থানীয় মানুষদের ছোটখাটো রোগের ভালো চিকিৎসা দিচ্ছেন বলে শুনেছি। এটা অবশ্যই ভালো ব্যাপার। তার জীবনবোধ কতটা উন্নত হলে এত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও এগিয়ে যাওয়া যায়। শুধু নিজেই ভালো থাকা না, পরিবারের পাশাপাশি স্থানীয়দের ফ্রিতে চিকিৎসা দেওয়া একটি প্রশংসনীয় কাজ। তার প্রয়োজনে আমরা পাশে থাকার চেষ্টা করব।
আরএআর