বাগানে এসেছে নতুন কুঁড়ি, ৩ মাস পর চা-পাতা সংগ্রহ শুরু
|
• ২০২১ সালে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৫ লাখ কেজি বেশি উৎপাদিত • চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৮০ লাখ কেজি বিজ্ঞাপন |
• উত্তরের পাঁচ জেলায় ১০ নিবন্ধিত ও ১৭ অনিবন্ধিত চা-বাগান • ৭,৩১০ ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগানের মোট চাষ ১০,১৭০.৫৭ একর বিজ্ঞাপন |
পঞ্চগড়ে তিন মাস বন্ধ থাকার পর শুরু হয়েছে সমতলের চা-বাগানগুলো থেকে চলতি মৌসুমের চা-পাতা সংগ্রহ কার্যক্রম। বাগানে সেচ, কীটনাশক ও পরিচর্যার জন্য তিন মাস পাতা কাটা বন্ধ ছিল। বসন্ত শুরু হতেই গাছে এসেছে নতুন কুঁড়ি। এতে চাষিদের মুখে ফুটেছে সবুজ-সোনালি হাসি।
অন্যদিকে কারখানাগুলোতেও শুরু হয়েছে তোড়জোড়। কাঁচা চা-পাতা সংগ্রহ ও চা উৎপাদনের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছে তারা। তবে চলতি মৌসুমে নতুন করে কাঁচা চা-পাতার দাম নির্ধারণ না হওয়ায় ন্যায্যমূল্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় জেলার ৫ উপজেলার হাজারো চা-চাষি।
মঙ্গলবার (১ মার্চ) সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, চাষি ও শ্রমিকরা বাগান থেকে পাতা সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বাগান থেকে চা-পাতা উত্তোলন করে বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে চাষিদের।
এখন বসন্তের আগমন ঘটেছে। বিদায় নিচ্ছে শীত। এ সময়টায় পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকার সমতলের চা-বাগানগুলোয় উঁকি দেয় নতুন কুঁড়ি। চা-গাছের পাতা বৃদ্ধি ও সুস্থতা এবং অধিক পাতা উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রতিবছরের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি টানা তিন মাস বাগানগুলোয় পাতা কাটা বন্ধ থাকে। এ সময় বাগানগুলোয় চলে প্রুনিং কার্যক্রম।
প্রতিবছরের ১ মার্চ থেকে চা-পাতা সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয়। সে মোতাবেক চাষিরাও আজ থেকে তাদের বাগানের উৎপাদিত চা-পাতা উত্তোলন করে কারখানায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কারখানাগুলোও চালু হয়েছে। তবে নতুন কাঁচা পাতার মূল্য নির্ধারণ না হওয়ায় ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে বেশ আতঙ্কে রয়েছেন চাষিরা।
তাদের দাবি, বিগত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে সার-কীটনাশক, ডিজেল ও শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। তবে চাষিদের অভিযোগ, চা-পাতার মূল্য ওঠানামা ও পাতা বিক্রির সময় কারখানাগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে চা-পাতা কর্তন বন্ধ না করা হলে লোকসানের মুখে পড়তে হবে তাদের। অন্যদিকে চাষিরা ন্যায্যমূল্য না পাওয়া ও মূল্য ওঠানামা করায় চাপ পড়ে চা-শ্রমিকদের ওপর। এতে শ্রমিকদের মজুরিও কমে যায়।
তেঁতুলিয়া উপজেলার আজিজনগর এলাকার চা-শ্রমিক রবিউল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন পর আজ থেকে আবারও বাগান থেকে পাতা উত্তোলনের কাজ করতে পারছি আমরা। এতে আমরা অনেক আনন্দিত। তবে প্রতিবছর কাঁচা চা-পাতার দর ওঠানামা করায় চাষিদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়। তার কারণে তারা আমাদের মজুরি বৃদ্ধি করে না। ফলে আমাদের মজুরি কম দেয়। তবে পাতার দাম ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকি।
একই কথা বলেন জাহিদুল ইসলাম নামে আরেক চা-শ্রমিক। তিনি বলেন, চা-বাগানে কাজ করে যা আয় করি তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। তিন মাস কাজ বন্ধ ছিল। আজ থেকে পুনরায় বাগান থেকে পাতা উত্তোলনের কাজ শুরু হয়েছে। আমরা আবারও পাতা উত্তোলন করতে পারব। এটাই বড় আনন্দ আমাদের। শীতে বাগানে তেমন কাজ ছিল না। শীতেও তেমন অন্য কাজ করতে পারিনি। কিন্তু কেউ আমাদের খবর রাখেনি আমরা কেমন ছিলাম।
চা বোর্ড জানায়, ২০২১ সালে জেলায় চায়ের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ কোটি কেজি চা, সেখানে উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৪৫ লাখ কেজি। ফলে গত বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৫ লাখ কেজি চা বেশি উৎপাদিত হয়েছে। চলতি বছরে জেলায় চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ কেজি। বোর্ড আরও জানায়, উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় ১০টি নিবন্ধিত ও ১৭টি অনিবন্ধিত চা-বাগান এবং ৭ হাজার ৩১০ ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগানের (নিবন্ধিত ১ হাজার ৫১০টি) মোট ১০ হাজার ১৭০ দশমিক ৫৭ একর জমিতে চা চাষ হয়েছে। পঞ্চগড় ১৭টি ও ঠাকুরগাঁও ১টি মোট ১৮টি চা কারখানা চলমান রয়েছে।
কথা হয় তেঁতুলিয়ার বোয়ালমারী এলাকার চা-চাষি রুবেল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার পাঁচ বিঘা জমিতে চা-বাগান রয়েছে। আজ থেকে বাগানে চা-পাতা কাটা শুরু করেছি। আর চা-বাগানের ওপর নির্ভর করে আমাদের চলতে হয়। তবে কয়েক বছর ধরে চা-তার দাম নিম্ন থাকায় আমাদের তেমন লাভ হয় না। একদিকে পাতার দাম ওঠানামা ও কারাখানাগুলো চা-পাতা থেকে বিভিন্ন অজুহাতে কর্তনের ফলে আমরা খুব বেশি লাভ করতে পারি না। তবে বিগত বছরের চেয়ে এ বছর খরচ ও শ্রমিকের মজুরি বেশি থাকায় ভালো দাম না পেলে লোকসানে পড়ে যাব।
তেঁতুলিয়া গ্রিন কেয়ার অ্যাগ্রো লিমিটেডের ম্যানেজার মো. মঞ্জুর আলম বলেন, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সামনে রেখে চলতি মৌসুমে কারাখানা চালুর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এবং চালুও করা হয়েছে। আজ থেকে চা-পাতা সংগ্রহ শুরু হয়েছে। এটা চলবে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত। আমরা সরাসরি চাষিদের কাছে থেকে চা-পাতা কিনছি। চাষিরাও বাগানের নতুন পাতা বিক্রি করে বেশ আনন্দ পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ চা বোর্ড (পঞ্চগড়), নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, আজ ১ মার্চ থেকে চলতি বছরের চা-পাতা সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে চাষিরা তাদের বাগান থেকে চা-পাতা উত্তোলন ও কারখানা কর্তৃপক্ষ চা-পাতা থেকে চা উৎপাদন করতে সব সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, চাষিদের আমরা সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। তবে চলতি মৌসুমে এখনো নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়নি। তবে চা নিলামের ওপর নির্ভর করে কাঁচা পাতার দাম নির্ধারণ করা হবে। দাম নিয়ে চাষিদের কোনো সমস্যা হলে আমরা সমস্যা সমাধানে কাজ করব।
মো. রনি মিয়াজী/এনএ