নিবন্ধিত ৮ হাজার, নগরে চলছে ৪০ হাজার
রংপুর নগরের প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব সড়কই এখন ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জার রিকশার দখলে। বৈধ-অবৈধ মিলে ৪০ হাজারের বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও চার্জার রিকশা চলাচল করছে।
অথচ সিটি করপোরেশন থেকে নিবন্ধন (লাইসেন্স) দেওয়া রয়েছে ৮ হাজার ২৪০টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার। দুর্ঘটনাপ্রবণ ও বিপজ্জনক এসব হালকা যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও বাস্তবে চিত্র উল্টো।
বিজ্ঞাপন
সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো রিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ঠাসা। যাত্রী দেখলেই চালকরা যেখানে-সেখানে রিকশা বা অটোরিকশা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। আবার সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে যাত্রীর আশায় অটোরিকশাগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। থেমে থেমে কোথাও অটোরিকশার জটলা তৈরি হয় আবার কোথাও দীর্ঘ সারি হয়ে যায়। এই দীর্ঘ সারির কারণে পথচারীদের সড়কের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়াও বেশ কষ্টকর।
তীব্র যানজটের শিকার রেজিনা সাফরিন। পেশায় শিক্ষক এই নারী তার ফেসবুকের ওয়ালে লিখেছেন: রংপুর জজ কোর্টের সামনে যানজটে ২৩ মিনিট ধরে বসে আছি। তার আগে থেকেই চলছে যানজট।
বিজ্ঞাপন
নগরের মর্নিং গ্লোরি চিলড্রেন্স স্কুলের এই অধ্যক্ষের স্ট্যাটাসের কমেন্টস বক্সে সুমাইয়া তাবাসসুম নামে একজন লিখেছেন: দু-দিকের রাস্তা চওড়া হলেও ব্রিজটা অনেক ন্যারো। এ কারণেই যানজট সহজে শেষ হয় না। ওই রাস্তায় আমিও একবার রিকশায় বসে দেড় ঘণ্টা আটকে ছিলাম।
নগরের কাচারী বাজার মোড় থেকে পুলিশ লাইনস স্কুল মোড়, টাউন হল চত্বর মোড় (লক্ষ্মী টকিজের সামনে), সিটি করপোরেশন ও সিটি বাজারের মোড়, সুপার মার্কেট মোড়, পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি মোড় পর্যন্ত সকাল থেকে সন্ধ্যা পুরোটা সময়ই যানজট থাকে। জাহাজ কোম্পানি মোড় এলাকায় চারদিক থেকে চারটি সড়ক এসে মিলেছে। এ মোড়ের চারদিকেই বিপণিবিতান অবস্থিত। এখানেও সড়কের মধ্যে অটোরিকশার স্ট্যান্ড দেখা যায়। এই মোড়ের পাশে নগরের প্রধান ব্যবসায়িক কেন্দ্র হাঁড়িপট্টি, লোহাপট্টি ও বেতপট্টি। এই এলাকার ছোট সংযোগ সড়কগুলোয় কেনাকাটা করতে এসে দীর্ঘ সময় মানুষকে যানজটে আটকে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
সিটি বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে বাড়ি ফিরছিলেন ইব্রাহিম মিয়া। কিন্তু চার্জার রিকশায় বসে থেকে যেন হাঁপিয়ে উঠেছেন। যানজটে আটকা পড়ে থাকা কলেজ রোড বিকন মোড়ের বাসিন্দা ইব্রাহিম বলেন, পুরো বাজার ঘুরে শাকসবজিসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী কিনতে এক ঘণ্টারও কম সময় লেগেছে। কিন্তু এখন দেখছি বাজার করতে যত সময় লাগে, তার থেকে বেশি সময় রাস্তায় চলে যাচ্ছে। সিটি বাজার থেকে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময়ে জাহাজ কোম্পানি মোড় পর্যন্ত এসেছি।
এদিকে পায়রা চত্বরের পাশে হারাগাছ সড়কের মধ্যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার স্ট্যান্ড। এতে রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। পায়রা চত্বর থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ, অটোরিকশায় গেলে সময় লাগছে আধঘণ্টা। এই সড়কের মতো রংপুর নগরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়কের ১২টি স্থানে ৩০টির বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। এর সব কটিই অবৈধ। এভাবে যত্রতত্র স্ট্যান্ডের কারণে নগরবাসীর দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
পায়রা চত্বরে কথা হয় চার্জার রিকশাচালক মিজানুর রহমানের। বদরগঞ্জের শ্যামপুর থেকে তিনি প্রতিদিন রংপুর নগরে এসে রিকশা চালিয়ে রাতে আবার গ্রামে ফিরে যান। সঙ্গে বৈধ কাগজপত্র না থাকার কথা স্বীকার করে এই রিকশাচালক বলেন, রংপুর শহরোত ভালোয় কামাই (উপার্জন) হয়। কিন্তুক একবার রিকশা নিয়্যা জ্যামোত (যানজট) পড়লে খুব সময় নষ্ট হয়। এ জ্যামের (যানজট) কারণে কোনো কোনো সময় আয়রোজগারও কম হয়। তার মতো শত শত চার্জার রিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক শহরে আছে, যারা একটু বাড়তি আয়ের আশায় রংপুরে এসেছেন বলেও তিনি জানান।
মেডিকেল মোড়ের ওষুধ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, চার্জার রিকশা আর ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার অটোর যন্ত্রণায় টেকা মুশকিল। এত বেশি রিকশা, অটোরিকশা দেশের অন্য কোনো বিভাগীয় শহরের নেই। অবৈধ এসব যানবাহনের কারণে আমাদের রাস্তা পারাপারে ঝুঁকি বাড়ছে, দুর্ঘটনাও ঘটছে।
স্থানীয় নাট্যশিল্পী নার্গিস রহমান বলেন, বছরের পর বছর এ অবস্থা দেখে আসছি। অটো তো কমছে না, বরং বাড়ছে। প্রতিটি মোড়েই অটোস্ট্যান্ড হয়েছে। যেখানে সেখান যাত্রী ওঠানো-নামানো হয়। এসব রিকশা ও অটোরিকশার চলাচল নিয়ন্ত্রণে কি কোনো সমাধান নেই?
রংপুর বিভাগীয় নগর হওয়ায় প্রতিদিন আশপাশের জেলা থেকে লাখো মানুষের আনাগোনা তো আছেই। তার ওপর ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জার রিকশার নিয়ন্ত্রণহীন বিচরণে অনেকটাই বেসামাল পুরো নগর। সড়কে বের হলে একাধিকবার পড়তে হয় ট্রাফিক সিগন্যালের মুখে। পুরো নগরে মানুষের ঘুরপাক আর অগোছালো স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান দেখে মনে হবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, অবৈধ এসব বাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন তারা।
সিটি করপোরেশনের মেয়রের দাবি, ব্যাটারিচালিত বৈধ অটোরিকশার সংখ্যা ৫ হাজার ২৪০ এবং বৈধ চার্জার রিকশার সংখ্যা ৩ হাজার। সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি নতুন আর কোনো নিবন্ধন দেননি। কিন্তু নগরজুড়ে বর্তমানে ১৫-২০ হাজারের মতো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও চার্জার রিকশা চলাচল করছে। সব রাস্তায় এসব যান চলাচল করার কারণে যানজট নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান বলেন, নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো যানজটমুক্ত রাখতে অনেকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু থেমে থেমে আবার একই ঘটনা ঘটছে। নতুন করে কোনো রিকশা ও অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। তারপরও নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন চলাচল করার কারণে এমনটি হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যেন যানজটের কারণে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে না হয়।
তিনি আরও বলেন, রাস্তা পারাপারে নগরের সিটি বাজার ও বাস টার্মিনাল এলাকায় পথচারীদের চলাচলের সুবিধার্থে দুটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। আগামীতে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে এধরণের আরো কয়েকটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনার কথাও জানান মেয়র।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এনএ