১৯৭১ সালের ৩ মার্চ সারা দেশের মতো উত্তাল ছিল রংপুর। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে ডাকা হরতালের পক্ষে শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়েছিল। সেই মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন কিশোর শংকু সমাজদার। স্বাধীনতাসংগ্রামে কিশোর শংকু সমজদার রংপুর অঞ্চলের প্রথম শহীদ। যার সাহস আর আত্মত্যাগ আজও রংপুরবাসীর স্মৃতিতে অমলিন।

স্বাধীনতাসংগ্রামে কিশোর শংকুর মৃত্যু মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। তার হুংকারে জ্বলে উঠেছিল বিদ্রোহের আগুন। শংকুর অকালমৃত্যু কাঁদিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও। তাই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে শংকু সমজদারের আত্মত্যাগকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণে ঠাঁই পায় রংপুর।

কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আক্ষেপ ঘোচেনি শহীদ পরিবারটির। প্রতিবছর শংকু সমজদারের মৃত্যুর দিনটি এ করকম নীরবেই কেটে যায়। থাকে না কোনো আয়োজন। স্বজনদের দাবি, শংকুর মৃত্যুর দিনটি সরকারি উদ্যোগে পালন করা হোক। সঙ্গে তার স্মরণে গড়ে তোলা হোক ম্যুরাল বা স্মৃতিস্তম্ভ।

দীপালী সমজদারের তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যা ঝর্না ব্যানার্জি বেঁচে আছেন। তিনি রংপুর নগরীর আদর্শ কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করছেন। করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে তার বেতন-সুবিধা বন্ধ রয়েছে। তার অসুস্থ স্বামী, দুই ছেলে-মেয়ে ও মা দীপালী সমজদার ছাড়াও সদ্য প্রয়াত বড় ভাইয়ের স্ত্রী ও ছেলে সন্তান মিলেই এখন তাদের পরিবার।

ঝর্না ব্যানার্জি ঢাকা পোস্টকে বলেন, একাত্তরের ৩ মার্চ আমার ভাই শংকু সমজদার বড় ভাইয়ের হাত ধরে মিছিলে গিয়েছিলেন। তখন আমার বয়স চার-পাঁচ হবে। সেদিন ওই মিছিলে গিয়ে চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে শংকুর মৃত্যু হয়। আমরা তার মরদেহটাও দেখতে পারিনি। যে ভাইয়ের হাত ধরে শংকু মিছিলে গিয়েছিল, সেই বড় ভাই কুমারেশ সমজদার গত বছরের ৩ জুলাই মারা গেছেন।

‘আমার ৮৫ বছর বয়সী মা ভীষণ অসুস্থ। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর এখন বাড়িতে শয্যাশয়ী অবস্থায় তার দিন কাটছে। আমার মা এবং আমাদের চাওয়া, ৩ মার্চ শংকুর মৃত্যুর দিনটি সরকারি উদ্যোগে অথবা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পালন করা হোক। আর যদি একটা ম্যুরাল বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা যায়, তাহলে আমার মা সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন।’

তিনি আরও বলেন, আমার ভাই দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছেন। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। সরকার আমার ভাইকে শহীদের মর্যাদা দিয়েছে। জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা আমাদের সহযোগিতা করেছে। আমরা সবার কাছে কৃতজ্ঞ।

দেখতে দেখতে প্রিয় সন্তান শংকু সমজদারকে ছাড়াই ৫০টি বছর কেটে গেছে বৃদ্ধা মা দীপালি সমজদারের। বর্তমানে রংপুর মহানগরীর কামাল কাছনায় সরকারের দেওয়া একটি বাড়িতে পরিবার নিয়ে বাস করছেন তিনি। জীবন সায়াহ্নে অসুস্থতা আর সন্তানের স্বীকৃতির না থাকায় আক্ষেপে দিন কাটছে তার। শহীদের তালিকায় শংকুর নাম গেজেটভুক্ত হলেও জোটেনি সরকারি ভাতা। বর্তমানে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মাসিক ভাতা দিয়ে শহীদ পরিবারটিকে সহায়তা করছেন।

শয্যাশয়ী দীপালী সমজদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণে আমার ছেলে শংকুর জন্য রংপুরের কথা বলেছেন। শহীদের মা হিসেবে আমাকে দুই হাজার টাকাও দিয়েছেন। সরকার থেকে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। এখন আমার একটাই চাওয়া, শংকুকে আগামী প্রজন্মের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে তার স্মরণে একটা ম্যুরাল বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক। আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় ভালোবাসার ফুল দিয়ে শংকুর আত্মত্যাগকে পূজা করতে চাই। সরকারসহ রংপুরের প্রশাসনের কাছে আমার এটাই শেষ চাওয়া।

একাত্তরের ৩ মার্চের সেই উত্তাল দিনের কথা বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু। তার ভাষ্যমতে, ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পর সারা দেশের মতো উদ্বেলিত হয়েছিল রংপুরের মানুষও। ইয়াহিয়া খান একাত্তরের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলেও ১ মার্চ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল পূর্ব বাংলা। সারা দেশের মতো রংপুরেও দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল বিদ্রোহের আগুন।

‘পূর্বনির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত হওয়ার প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। এরই ধারাবাহিকতায় রংপুরে হরতাল পালিত হয়। পাকিস্তানি দখলদারদের শোষণ-শাসন এবং ষড়যন্ত্রের খপ্পর থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল রংপুরের মানুষ।’

মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক এই কমান্ডার বলেন, ৩ মার্চ সকালে হরতালের সমর্থনে কাচারী বাজার এলাকা থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম গোলাপ, অলক সরকার, মুকুল মুস্তাফিজ, নূর উর রসুল চৌধুরী, হারেস উদ্দিন সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, মুসলিম উদ্দিন (মুসলিম কমিশনার), আবুল মনসুর আহমেদসহ আরও অনেকের নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে বড় ভাইয়ের হাত ধরে যোগ দেন কৈলাশ রঞ্জন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শঙ্কু সমজদার। মিছিলটি শহরের তেঁতুলতলা (বর্তমান শাপলা চত্বর) এলাকায় আসতেই কলেজ রোড থেকে কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি শহীদ মুখতার ইলাহি (কয়েক মাস পরে শহীদ হন), জায়েদুল আলম, জিয়াউল হক সেবুসহ অন্যদের নেতৃত্বে একটি মিছিল এসে যোগ দেয় মূল মিছিলের সঙ্গে।

‘মিছিল এগিয়ে চলে স্টেশন অভিমুখে। মিছিলটি আলমনগর এলাকার অবাঙালি ব্যবসায়ী সরফরাজ খানের বাসার (ঘোড়াপীর মাজারের পাশে) সামনে যেতেই এক কিশোর ওই বাসার দেয়ালে একটি উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ড দেখে তা নামিয়ে ফেলতে উদ্যত হয়। আর তখনই বাসার ভেতর থেকে মিছিলটি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয় কিশোর শংকু সমজদার। সঙ্গে সঙ্গে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ কিশোরকে শংকুকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে মুসলিম উদ্দিন কমিশনার হাসপাতালের দিকে দৌড়ালেন। কিন্তু পথেই কিশোর শংকু মারা যায়। হয়ে যায় ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রামে রংপুর অঞ্চলের প্রথম শহীদ কিশোর শংকু সমজদার।’

তিনি আরও বলেন, ৩ মার্চের ওই ঘটনায় অবাঙালিদের হাতে আরও দুজন শহীদ হয়েছেন। তাদের একজনের নাম আবুল কালাম আজাদ, অপরজন ওমর আলী। বাসা শহরের মুলাটোলে। এ ছাড়া সেদিন আরও দুজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। যাঁদের একজন শরিফুল ইসলাম মকবুল এক মাস হাসপাতালে থেকে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। পায়ে গুলিবিদ্ধ মোহাম্মদ আলী বেঁচে যান। একই দিন বিকেলে ঢাকার মৌচাক মোড়ে শহীদ হন কলেজ ছাত্র ফারুক ইকবাল।

এদিকে কিশোর শংকু সমজদারের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভের আগুনে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পুরো রংপুর। গুলিবিদ্ধ কিশোর শংকুর রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখে জনতা উত্তেজিত হয়ে অবাঙালিদের দোকান ভাঙচুর ও দোকানের সামগ্রী রাস্তায় এনে অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। যে বাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছিল সেই বাড়িতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে উত্তেজিত জনতা। কিন্তু ইপিআর বাহিনী এসে বাধা দেন।

স্বাধীনতা আন্দোলনে রংপুরের প্রথম শহীদ কিশোর শংকু সমজদারের মায়ের ইচ্ছা পূরণে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উমর ফারুক গড়ে তুলেছেন শহীদ শংকু সমজদার বিদ্যানিকেতন।

তিনি বলেন, শহীদ শংকু সমজদার একটি সাহসের নাম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে এই নামটি জড়িয়ে আছে। রংপুরের মানুষের আবেগের সঙ্গে এই নামের সম্পর্ক। তার মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী আমরা ব্যক্তি উদ্যোগে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছি। এই প্রতিষ্ঠান থেকে আগামী প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ শহীদ শংকুর চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানাতে আমরা কাজ করছি।

এনএ