স্বামীর মৃত্যুর পর তাড়িয়ে দেয় শ্বশুরবাড়ি, সাবিনা আজ সমাজের আদর্শ
সাবিনা যখন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী, তখন তার বিয়ে হয় গাংনীর থানা পাড়ায়। মাদকাসক্ত স্বামীর ঘরে যাওয়ার পর সহ্য করতে হয় অমানুষিক নির্যাতন। ২০১২ সালে এক শিশু ছেলে ও মেয়েকে রেখে একদিন স্বামী মারা যান। এবার শুরু শাশুড়ি, ননদ ও দেবর-ভাসুরের অত্যাচার। ঠাঁই হয়নি আর। ফিরে আসেন পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের পরিবারে। ঠাঁই দেয়নি আপনজনও। তাই অসহায় মা-বাবার কাছে আর থাকতে পারেননি। তবু হাল ছাড়েননি।
শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। কিছু টাকা জমিয়ে স্থানীয় বাজারে একটি দোকান ভাড়া নেন। সেলাইয়ের কাজের পাশাপাশি চা, খাবার, প্রসাধনী ও মুদি মাল বিক্রি শুরু করেন। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ব্যবসার আয় দিয়ে নিজের সংসার, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনাসহ মা-বাবারও দেখাশোনার দায়িত্ব নেন সংগ্রামী নারী সাবিনা ইয়াসমিন।
বিজ্ঞাপন
স্বামীর সংসারে ঠাঁই না হলে সমাজে নারীরা নানা নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হন প্রতিনিয়ত। তবু তারা আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন। অনেকেই নানা প্রতিবন্ধকতা আর অর্থনৈতিক কারণে নিজেকে মেলে ধরতে পারেন না। আবার কেউ কেউ শূন্য থেকে শুরু করে সফলতার গল্প তৈরি করে সমাজকে জানিয়ে দেন যে সুযোগ পেলে নারীরাও পারেন নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার রাইপুর ইউনিয়নের হাড়িয়াদহ গ্রামের তহির উদ্দীনের মেয়ে সাবিনা এমন আত্মপ্রত্যয়ী ও জীবনসংগ্রামী নারী।
সরেজমিনে হাড়িয়াদহ বাজারে গেলে দেখা গেছে, সাবিনার দোকানে থরে থরে সাজানো মালামাল। এক পাশে চায়ের বিকিকিনি। অন্য পাশে সেলাইয়ের মেশিন। ক্রেতাকে পণ্য বুঝিয়ে দিয়ে এসে আবার করছেন সেলাইয়ের কাজ। পাশে বসিয়ে মেয়েকে পড়াচ্ছেন। এদিকে বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছে পণ্যের অর্ডার দিচ্ছেন। বিদায় করছেন পাওনাদারদের। এভাবে সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত একাই সামলাচ্ছেন সবকিছু। মাঝেমধ্যে বাবা তোহির উদ্দীন এসে কিছুটা সহযোগিতা করছেন।
বিজ্ঞাপন
এখানেই শেষ নয়, সাবিনা বাড়িতেও গড়ে তুলেছেন গরু ও হাঁস-মুরগির খামার। পাশে কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন করেন। সেই সবজি বাজারে বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা আয় করেন। বাবার বাড়িতে ভাই-বোনদের কাছে ঠাঁই না হওয়া সাবিনার কাছে এখন বৃদ্ধ মা-বাবার সব দায়িত্ব।
স্থানীয় লোকজনও এখন সাবিনার ভক্ত। আগের মতো সাবিনাকে আর কারও কটু কথা শুনতে হয় না। তার দেখাদেখি বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত অনেক নারীই সেলাইয়ের কাজ বা দোকানি পেশা বেছে নিয়েছেন।
উদ্যোক্ত ও সাহসিকা সাবিনা ঢাকা পোস্টকে জানান, ১০ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়ি। কিন্তু হাল ছাড়িনি। শক্তভাবে হাল ধরেছি বলে আজ আমি স্বাবলম্বী হয়েছি। একমাত্র আয়ের উৎস সেলাই মেশিন দিয়ে শুরু করি। আস্তে আস্তে ভাগ্যের পরিবর্তন করেছি। সমাজেও আমি এখন সফল নারী ব্যবসায়ী।
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে আবু সাইদ নবম শ্রেণিতে পড়ে আর মেয়ে সুরাইয়া পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। করোনার কারণে তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বাসায় পড়াশোনা চালু রাখি। এখন স্কুল চালু হয়েছে। তাদের নাওয়া-খাওয়া শেষ করে স্কুলে দিয়ে এসে শুরু করি ব্যবসার কাজ।
শ্বশুরবাড়িতে ও বাবার ঘরে ঠাঁই না হওয়ায় প্রতিবেশী আকছার আলী মানবিক কারণে তার জায়গায় থাকতে দেন সাবিনাকে। সেখানে একটি ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে বসবাস করতে থাকেন। পরিবার-পরিজন সেখানে কোনোমতে দিন যাপন করেন। ইতোপূর্বে সরকারি ঘরের জন্য আবেদন করলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
সাবিনার প্রতিবেশী ওসমান জানান, সাবিনার এই জীবনসংগ্রামে তারা আর্থিক সহযোগিতা করতে না পারলেও সাহস জুগিয়েছেন। সাবিনা এখন একজন ব্যবসায়ী। তার মতো সমাজের নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সাবিনার বাবা তোহির উদ্দীন জানান, অর্থাভাবে মেয়ে সাবিনাকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। তাই বাল্য বয়সে বিয়ে দিতে হয়। নিজের কোনো আয়-রোজগার নেই। সাংসারিক কারণে স্বামী হারানোর পর তাকে জায়গাও দিতে পারেননি। কিন্তু সাহস দিয়েছেন। এখন মেয়েই তার দেখাশোনা করছেন।
জেলা সমাজসেবা নিবন্ধন কর্মকর্তা আরশাদ আলী জানান, জেলায় বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা ও নিগৃহীত নারীদের বাছাই করে সাড়ে ৮ হাজারেরও বেশি নারীকে সরকারি ভাতা প্রদান করে থাকি। তবে নারীদের আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলতে সামাজিক উৎসাহ জোগাতে হবে। সমাজের অনেক কুসংস্কার নারীদের পিছিয়ে রেখেছে। পরনিন্দার ভয়ে অনেক নারীই কর্ম করতে না পেরে নীরবে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে চলেছেন। তবে সাবিনা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সে জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই।
রাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গোলাম সাকলায়েন বলেন, আমাদের সমাজে নারীদের কাজ করে সংসার চালানো কিংবা হাটবাজারে যাওয়াটা মানুষ ভালো চোখে দেখে না। সমাজের মানুষ কারও রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে দিতে না পারলেও পেছন থেকে আজেবাজে কথা বলতে ভালোই পারেন। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সাবিনা সাবলম্বী হয়েছেন, সফল হয়েছেন। সাবিনার আজ সুদিন। তবু নারীদের এগিয়ে যেতে হবে।
মেহেরপুর জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নীল হাফিয়া বলেন, সাবিনা ইয়াসমিন আমাদের সমাজ পরিবর্তনের একটি উদহারণ। তিনি কারও সহযোগিতা ছাড়া নিজের অসহায়ত্ব জীবনের অবসান ঘটিয়ে আজ সাবলম্বী। স্বামীর সংসার ছেড়ে আসা নারীরা বাবা-মায়ের বোঝা হয়ে যান। আমরা এবং সমাজের সবাই তাদের পাশে দাঁড়ালে, সাহস ও উৎসাহ দিলে সব নারী নতুনভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণা পাবেন। মেহেরপুরে এমন আতত্মপ্রত্যয়ী ও জয়িতা রয়েছেন শতাধিক। তারা সংগ্রাম করে জীবন চালিয়ে আসছেন।
তিনি আরও বলেন, জেলায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা নারীদের আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলছি। সেলাই, ব্লক বাটিক, বিউটিফিকেশনসহ নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে অসংখ্য নারীকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলছি। সামনে এমন নারীদের সহযোগিতা করা হবে।
এনএ