শেষ হলো লালন স্মরণোৎসব, খাবারের মান নিয়ে ভক্তদের ক্ষোভ
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব শেষ হয়েছে। লালন ভক্তদের প্রথাগত নিয়মে পুণ্যসেবার মধ্য দিয়ে শুক্রবার (১৮ মার্চ) দুপুরে এ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। তবে পুণ্যসেবায় দেওয়া খাবারের মান ও পরিমাণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক ভক্ত-অনুসারী।
জানা গেছে, ফকির লালন শাহ্ তার জীবদ্দশায় অনুসারীদের নিয়ে সাধুসঙ্গ শেষ করতেন কলাপাতায় ভাত, ইলিশ মাছ, ডাল, সবজি ও দই খাওয়ার মাধ্যমে। সেই রীতি অনুযায়ী লালন একাডেমি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় যুগ যুগ ধরে এসব খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু এবার কলাপাতার পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম প্লেট আর ইলিশের পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে রুই মাছ। ভাতের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে সবজি, কালাইয়ের ডাল, দই।
বিজ্ঞাপন
খাবারের মান ও পরিমাণ নিয়ে অভিযোগ করে ভক্ত-অনুসারীরা বলেন, ইলিশ মাছ দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে রুই মাছের ছোট্ট একটা টুকরো। অল্প একটু দই দেওয়া হয়েছে। নিম্নমানের চালের ভাত ও ডাল দেওয়া হয়েছে। খাবার দিতেও দেরি করেছেন আয়োজকরা। এবারের খাবারের মান খুবই নিম্নমানের হয়েছে। আগামীতে আমরা ভালো খাবারের দাবি জানাচ্ছি এবং নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করায় ক্ষোভ প্রকাশ করছি।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা যায়, লালন ফকিরের মাজার প্রাঙ্গণ ও অডিটোরিয়ামে সারিবদ্ধভাবে বসে খাচ্ছেন ভক্ত-অনুসারীরা। তাদের খেতে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। কেউ ভাত দিচ্ছেন, কেউ তরকারি, কেউ দই, ডাল ও পানি দিচ্ছেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভক্ত-অনুসারীরা খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বিদায় নেন আখড়াবাড়ি থেকে। তবে অনেকে পরে যাবেন।
বিদায়বেলায় আখড়াবাড়ির পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। গুরুভক্তি আর সিদ্ধ মন নিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় অনেক বাউল তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। গুরুকে বারবার প্রণাম ও নানা রকম ভক্তি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিদায় নেন তারা।
শুক্রবার দুপুরে তারা কালি নদীতে গোসল সেরে পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। প্রায় ৭ হাজার বাউল, ভক্ত, দর্শনার্থীরা একসঙ্গে বসে ‘আল্লাহ আলেক’ নাম নিয়ে পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। এই সেবার মধ্য দিয়ে শেষ হয় লালন স্মরণোৎসব।
খাবারের দায়িত্বে থাকা লালন মেলা আয়োজক কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন জানান, ফকির লালন শাহ্ তার জীবদ্দশায় যেভাবে সাধুদের আপ্যায়ন করতেন, তারাও সেই নিয়মে সাধুদের আপ্যায়ন করেন। খাবারের জন্য ৩ হাজার কেজি চাল, ৬০০ কেজি রুই মাছ, ৩০০ কেজি ডাল, ৪০০ কেজি দই এবং ৫০ কেজি মুড়ির ব্যবস্থা করা হয়। এবারে পর্যাপ্ত কলা পাতা না পাওয়ায় বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম প্লেট ব্যবহার করা হয়। আর ইলিশ মাছের সরবরাহ কম থাকায় বিকল্প হিসেবে দেওয়া হয় রুই মাছ।
জানা গেছে, লালন শাহের জীবদ্দশায় চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহে পূর্ণিমার রাতে দোল পূর্ণিমার উৎসব পালন করা হতো। সেই থেকে লালন ভক্তরা প্রতি বছরই নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের কাঙ্ক্ষিত এ উৎসব পালন করেন। সাঁইজির স্মরণে দিবসটি ঘিরে তিন দিনের অনুষ্ঠান হয় আখড়াবাড়িতে। আধ্যাত্মিক গুরু ফকির লালনকে স্মরণ এবং তার দর্শন থেকে সাঁইজির ধামে আসা ভক্তরা ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও মুক্তির স্বাদ খোঁজেন।
লালন একাডেমির অ্যাডহক কমিটির সদস্য তাইজাল আলী খান বলেন, ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণ মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল। দেশ-বিদেশ থেকে লালনভক্ত, বাউল অনুসারী ও সুধীজনসহ অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটেছিল এখানে। শুক্রবার পুণ্যসেবার মধ্য দিয়ে স্মরণোৎসব শেষ হয়েছে। ভক্ত-অনুসারীরা বাড়ি চলে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, দুপুরে পুণ্যসেবার খাবার খেয়েছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। খাবারের কোনো ঘাটতি ছিল না। সুন্দরভাবে পুণ্যসেবাসহ লালন স্মরণোৎসবের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন একাডেমির আয়োজনে তিন দিনব্যাপী এ লালন স্মরণোৎসব শুরু হয়। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে লাখো লালন ভক্ত-অনুসারী ও দর্শনার্থীরা এসেছিলেন লালন আখড়াবাড়িতে।
রাজু আহমেদ/আরএআর