ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী মাহবুব আলমের মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। মাহবুব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বিষয়টি আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী ও পরিবারের সদস্যরা কেউই বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাদের দাবি- মাহবুবকে হত্যা করা হয়েছে। 

শুক্রবার (১৮ মার্চ) বেলা ১১টার দিকে গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল পৌরসভার সাখিদারপাড়া মহল্লায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। সহপাঠী-পরিবারের সদস্যসহ অনেকের কাছে তার মৃত্যু রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে। 

মাহবুবের সহপাঠীরা জানান, বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেনের ছাদের ওপর থাকা অবস্থায় মাহবুব তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টের স্টোরিতে সর্বশেষ একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। সেই পোস্টে রাতের ছবিতে মাহবুব ট্রেনের ছাদের ওপরে বসেছিলেন এবং একটি ছবিতে মাহাবুবসহ দুইজন রয়েছেন। ওই পোস্টে লেখা ছিল- ‘অফ টু কুষ্টিয়া। কঠিন তবুও আনন্দঘন, মাঝপথে জুটেছিল, অপরিচিত সঙ্গী।’ ট্রেনের ছাদে মাহবুব আলমের পেছনে অপরিচিত ওই ব্যক্তিকে ঘটনার পর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাহবুবের কাছে টাকা কম থাকলেও তার কাছে দুটি দামি মোবাইল ছিল। সেই দুটি মোবাইল অক্ষত ছিল।

মাহবুবের সহপাঠী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র এমরান হোসেন বলেন, আমি বাসা থেকে গত শনিবার (১২ মার্চ) রাতে হলে আসি। পরদিন সকালে মাহবুব এসে বলে- ‘দোস্ত চল কুষ্টিয়া যাব, ঘুরতে।’ তখন বললাম আমাদের ২৭ তারিখে সেমিস্টার পরীক্ষা শুরু এবং ৯ তারিখে শেষ। এরপর বান্দরবান ঘুরতে যাব বন্ধুরা মিলে।  সে আমার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নেয়। তারপর কয়েকদিন তার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ হয়নি।

তিনি আরও বলেন, হঠাৎ বুধবার (১৬ মার্চ) রাতে তার ফেসবুকের স্টোরিতে একটি পোস্ট দেখতে পাই। সেই পোস্টে বুঝতে পারি, জার্নিটা রিস্কি এবং মজাদার ছিল। তবে ওই পোস্টে তার পাশে একটা ছেলে ছিল এবং ছেলেটা অপরিচিত। আর একা মানুষ কখনো রেলের ছাদে ওঠার কথা না। মাহবুব যদি রেললাইনে পড়ে যেত বা লোহাতে লাগতো তাহলে মাথা পুরোটাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু তার মাথার পেছনে চাইনিজ কুড়ালের মতো কিছু ঢুকে গেছে মনে হচ্ছে। অনেকটা ক্ষত ছিল। আমাদের দাবি এই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হোক। আসলেই এটি দুর্ঘটনা না ঘটানো হয়েছে।

আরেক সহপাঠী জয় বলেন, আমার বাসাও ক্ষেতলালে। মাহবুব আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। সে অনেক ভালো এবং সহজ সরল ছিল। কিন্তু কীভাবে যে এমন ঘটল। বিষয়টি আমরা মেনে নিতে পারছি না। এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই।

শুক্রবার সকালে নিহত মাহবুবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশে মাহবুবের মরদেহ রাখা হয়েছে। লোকজন তার মরদেহ এক নজর দেখার জন্য ভিড় করেছেন। বাড়ির ফটকের সামনে বাবা আব্দুল হান্নান মিঠু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। লোকজন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর বাড়ির ভেতর মাহবুবের মা বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। 

নিহত মাহবুবের মা মোছা. মৌলদা বলেন, বুধবার রাত ৯টার দিকে মোবাইলে ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছিল। সে তখন বলেছিল- মা আমি কুষ্টিয়া যাচ্ছি। কার সঙ্গে যাচ্ছো বলতেই বলল অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে। এরপর রাত ১২টায় আবার ফোন দিয়েছিলাম। ফোন আর রিসিভ করেনি। বৃহস্পতিবার সকালে খবর আসলো আমার ছেলে আর নেই।

তিনি বলেন, আমার ছেলে দুর্ঘটনায় মারা যায়নি। আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আমার ছেলে ট্রেনের ছাদে একটি ছবি ফেসবুকে দিয়েছিল। ওই ছবিতে আমার ছেলের পেছনে এক ব্যক্তিকে দেখা গেছে। ওই ব্যক্তিকে খুঁজে পেলেই আমার ছেলের মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন হবে।

মাহবুবের বাবা আব্দুল হান্নান মিঠু বলেন, আমার ছেলে দুর্ঘটনায় মারা গেছে সেটি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার ছেলের মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।

জয়পুরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আরিফুর রহমান রকেট বলেন,  আব্দুল হান্নানের একমাত্র ছেলে মেধাবী শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মাহবুব আলমের অকাল মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ এটি সত্যিই বেদনাদায়ক। আমরা এই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।

কুষ্টিয়ার পোড়াদহ রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনজের আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে হার্ডিঞ্জ রেলসেতু থেকে মাহবুবের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছিল। পরে মরদেহ পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে কীভাবে সে মারা গেল তা জানা যায়নি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে সঠিক তথ্য জানা যাবে।

নিহত মাহবুব আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ১০০৬ নম্বর কক্ষে থাকতেন। মা-বাবার একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল মাহবুব। তার ছোট আরেকটি বোন রয়েছে। তার বাবা আব্দুল হান্নান মিঠু জয়পুরহাট জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান।

চম্পক কুমার/আরএআর