সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের প্রথম জানাজা শনিবার (১৯ মার্চ) বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার পাইকুড়া ইউনিয়নের পেমই গ্রামের নিজ বাড়ির আঙিনায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

এর আগে বিকেল সোয়া ৩টার দিকে তার মরদেহবাহী হেলিকপ্টার কেন্দুয়া পৌর শহরের চকপাড়া এলাকার হেলিপ্যাডে অবতরণ করে। পরে সেখান থেকে মরদেহ পেমই গ্রামে আনা হয়। 

জানাজার আগে উপস্থিত এলাকাবাসীর উদ্দেশে সাহাবুদ্দিন আহমদের ছেলে সোহেল আহমদ অলিক বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমার বাবা গ্রামকে খুব ভালোবাসতেন। সব সময়ই গ্রামে আসতে চাইতেন। কিন্তু আমরা বিদেশে থাকায় বাবার গ্রামে আসা সম্ভব হয়নি। ভেবেছিলাম বাবাকে আপনাদের কাছে জীবিত নিয়ে আসব। কিন্তু তা আর হলো না।

সোহেল আহমদ অলিক বলেন, বাবা এলাকার লোকজনের সঙ্গে চলাফেরা করেছেন। আমার বাবার ভুল-ত্রুটি থাকলে সবাই ক্ষমা করে দেবেন।

জানাজা শেষে সাহাবুদ্দিন আহমদের মরদেহ নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন স্বজনরা। আগামীকাল রোববার সকাল ১০টায় বাংলাদেশ জাতীয় ঈদগাহ মাঠে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে সাবেক এই রাষ্ট্রপ্রধানকে ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

এর আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের মরদেহ সামনে রেখে নেত্রকোণার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সীর নেতৃর্ত্বে গার্ড অব অনার প্রদান করে পুলিশের একটি চৌকস দল।

এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্যের পক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগ, জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কফিনে ফুলের তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার (১৯ মার্চ) সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৯২ বছর। কয়েক বছর ধরে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।

সাহাবুদ্দিন আহমদ নেত্রকোণার কেন্দুয়া থানার পেমই গ্রামে ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা তালুকদার রেসাত আহমদ ভূঁইয়া ছিলেন একজন খ্যাতনামা সমাজসেবক এবং জনহিতৈষী ব্যক্তি। সাহাবুদ্দিন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমি থেকে সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিষয়ে একটি বিশেষ কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। 

গোপালগঞ্জ ও নাটোরের মহকুমা প্রশাসক পদে কিছু দিন চাকরির পর সাহাবুদ্দিন আহমদ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৬০ সালের জুন মাসে তাকে বিচার বিভাগে বদলি করা হয় এবং প্রশাসনের নির্বাহী বিভাগে তার চাকরির সমাপ্তি ঘটে। তিনি ঢাকা ও বরিশালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তাকে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে উন্নীত করা হয়। মাঝে তিনি প্রেষণে নিযুক্ত হয়ে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (১৯৭৩-৭৪)। এরপর বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সাহাবুদ্দিন আহমদকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। 

১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন। ওই ঘটনায় কয়েকজন ছাত্র নিহত হয় এবং বহু ছাত্র আহত হয়। কিন্তু ব্যাপক তদন্ত চালিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হলেও তৎকালীন সরকার এই তদন্ত প্রতিবেদন কখনোই জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি।

সাহাবুদ্দিন আহমদ ১৯৮৪ সালে গঠিত জাতীয় বেতন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য উচ্চ হারে বেতন স্কেল নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭৮ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আপিল আদালতের বিচারপতিদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন তিনি।

১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি সাহাবুদ্দিন আহমদকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। 

সাহাবুদ্দিন আহমদ ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর নেন।

জিয়াউর রহমান/আরএআর