পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রবাহিত পলি দিয়ে মোহনার বুকে জেগে উঠেছে দ্বীপ জেলা ভোলা। ভোলার আরেকটি দ্বীপ মনপুরা উপজেলা। প্রাচীন এ উপজেলার চারদিক মেঘনা নদীবেষ্টিত। বছরের পর বছর বন্যা ও নদীর উত্তাল ঢেউয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দ্বীপটি।

বর্তমানে দ্বীপটি হুমকিতে রয়েছে। দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত মনপুরাকে রক্ষার্থে এবার নদীভাঙন রোধ ও টেকসই বাঁধ নির্মাণে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।

এর অংশ হিসেবে গত ২২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এক হাজার ১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকার নদীভাঙন রোধ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় মনপুরা উপজেলার ৫২ কিলোমিটার উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, উপজেলার চারদিকে ১৭১টি সাব মার্সিবল স্পার নির্মাণ, ৩৭ কিলোমিটার এলাকায় জিও ব্যাগ ও টিউব ডাম্পিং এবং ১০ টি স্লুইচ গেট নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

দীর্ঘদিনের দাবি পূরণের খবরে আনন্দে ভাসছে সাগর পাড়ের দ্বীপ উপজেলা মনপুরা দ্বীপের লক্ষাধিক মানুষ। মনপুরা উপজেলার ভাঙনকবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা আনন্দ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি দ্রুত ও সঠিকভাবে কাজ করার দাবি জানান। 

উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউয়ার টেগ গ্রামের বাসিন্দা ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘সত্তরের বন্যার পরপরই নদীয়ে আমাগো ভাগতে ভাগতে জমিজমা সব নদীয়ে লইয়া গেছে। এহন জায়গাজমিও নাই, কোনো রকম বেড়ির সাইডে বসবাস করতেছি। এহন হুনা যায় সরকার ব্লগ দিব, বেড়ি দিব। এগুলার উছিলায় আল্লাহ যদি রক্ষা করে।’

সাকুচিয়া জনতা ঘাট এলাকার হামিদ আলী বলেন, ‘নদীয়ে এই লইয়া তিন ভাঙা দিছে, এহন আবারও আমাগোরে নদীতে দরছে। ভাঙতি এলাকায় চেয়ারম্যান মেম্বাররা অনেক জিও বস্তা ফালাইছে, এহন আবার আমাগোরে নদীত ধইরা ফালাইছে। এহন আমাগো কোনো কিছু নাই যে অন্য খানে জমি কিনমু। সরকার বলে ব্লগ দিব। হেনে যেই বরাদ্দ হইছে তা দিয়া যদি ঠিকভাবে কাজ হয়, তয় মনপুরা আর ভাঙব না।’

দক্ষিণ সাকুচিয়া গ্রামের আলী আহমদ বলেন, ‘প্রতি বর্ষায় আমাদের বাড়িসহ মনপুরা ভাঙতে ভাঙতে ছোট হয়ে যাচ্ছে। তাই সরকার মনপুরার নদী ভাঙন রোধের কাজ বর্ষার আগে শুরু করলে আমাদের ভিটা বাড়ি কিছুটা রেহাই পাবে।’

মনপুরা ইউনিয়নের ইশ্বরগঞ্জ গ্রামের বেলাল খান বলেন, সরকার প্রধান বিগত সময়ে মনপুরাকে নদীভাঙন থেকে রক্ষার জন্য একাধিক প্রকল্প পাস করেছেন। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খামখেয়ালির কারণে কোনো প্রকল্পই আমাদের জন্য সুফল নিয়ে আসে না। সরকার সেনাবাহিনীর মাধ্যমে অনুমোদিত কাজটি বাস্তবায়ন করলে মেঘনার রাক্ষুসে থাবা থেকে মনপুরাবাসী রক্ষা পাবে।

মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে মনপুরা ও চরফ্যাশনের বিস্তীর্ণ এলাকা। এতে ভিটেমাটি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। শুধু আলী আহমদ, বেলাল খান, হামিদ আলী নয়, মনপুরা উপজেলার লক্ষাধিক বাসিন্দা মনে করেন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে তাদের ঘরবাড়ি, কৃষি জমি, বাজার, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, সড়ক ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রক্ষা পাবে।

মনপুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিনা আক্তার চৌধুরী বলেন, গত কয়েক বছর ধরে নদী ভাঙনের মুখে রয়েছে মনপুরা। এতে অনেক মানুষ গৃহহীন হয়েছে। মনপুরাকে নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। আমাদের সেই দাবি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের প্রতি মনপুরাবাসী কৃতজ্ঞ। প্রকল্পটি পাস হওয়াতে মনপুরার মানুষ অনেক আনন্দিত। একই সাথে ভাঙন রোধের কাজটি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানাই।

ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিভিশন-২  নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসান মাহমুদ জানান, মনপুরা উপজেলায় বাঁধ রয়েছে সর্বমোট ৭৬ কিলোমিটার। বিভিন্ন সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ও জোয়ারসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওই সব বাঁধের বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাই টেকসই বাঁধ দিয়ে মনপুরাকে রক্ষায় দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছিলেন মনপুরাবাসী। অবশেষে তাদের দীর্ঘদিনের সেই দাবি এখন বাস্তবায়নের মুখে।

তিনি আরও জানান, অতিদ্রুত এসব বাঁধের কাজ শুরু হবে। মনপুরাবাসীকে নদীভাঙন থেকে রক্ষায় সম্প্রতি এক হাজার ১৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক (জিডি) নিয়োগ ও টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হলেই ভাঙন রোধের কাজ শুরু হবে।

ইমতিয়াজুর রহমান/আরএআর