পা দিয়ে লিখে কৃতিত্বে সঙ্গে এসএসসি পাস করা তামান্না নূরার পর এবার হাত-পা ছাড়া জন্ম নেওয়া যশোরের শারীরিক প্রতিবন্ধী লিতুন জিরার পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি লিতুন জিরার পড়াশোনা ও চিকিৎসার জন্য তাকে ৫ লাখ টাকা অর্থসহায়তা দিচ্ছেন। 

আগামী ৩ এপ্রিল রোববার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে শেখ হাসিনা নিজ হাতে লিতুন জিরাকে আর্থিক সহায়তার চেক প্রদান করবেন। এর আগে ৩ মার্চ শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করে চিঠি লিখেন লিতুন জিরা। সেই চিঠি পেয়েই প্রধানমন্ত্রী লিতুনের খোঁজ খবর নেয়। 

এর আগে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার শারীরিক প্রতিবন্ধী তামান্না নূরার কৃতিত্ব দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহেনা তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং তাকে সহযোগিতা করেন।  

গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে প্রবেশের অনুমতি ও ৫ লাখ টাকা অর্থসহায়তা পাওয়ার বিষয়ে একটি চিঠি এসেছে লিতুন জিরার বাড়িতে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন লিতুন জিরার বাবা হাবিবুর রহমান। পুরো বিষয়টিতে দারুণ ভূমিকা রেখেছেন টিম পজিটিভ বাংলাদেশের কর্ণধার ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। 

তিনি বলেন, গতমাসে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছিলাম, তামান্না নূরার মতো অদম্য মেধাবী লিতুন জিরাও যেন তার স্নেহের আঁচল তলে ঠাঁই পায়। তিনি সেই আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে লিতুন জিরার লেখাপড়া ভালোভাবে চালিয়ে নিতে 'প্রধানন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল' থেকে ৫ লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য বরাদ্দ করেছেন এবং অনাগত আগামীতে লিতুন জিরার যেকোনো নৈতিক প্রয়োজনে পাশে থাকার স্বদিচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। ইনশাল্লাহ, সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে আমাদের বোন এগিয়ে যাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। লিতুন জিরার জন্য অনেক শুভকামনা ও ভালোবাসা।

রাব্বানী বলেন, ইতোপূর্বে টিম পজিটিভ বাংলাদেশ (টিপিবি) এর পক্ষ থেকে 'দেশরত্ন শেখ হাসিনার ভালোবাসার উপহার' হিসেবে যৎসামান্য আর্থিক সহায়তা ও খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছি লিতুন জিরার বাড়িতে। লিতুন জিরার বাবা হাবিবুর রহমান একটি নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে রীতিমতো বেকার খাটছেন। তিনি ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত খানপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। এরপর মনিরামপুর উপজেলা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে উপজেলা তাঁতীলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

লিতুন জিরা যশোরের মনিরামপুর উপজেলার শেখপাড়া খানপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান ও জাহানারা বেগম দম্পতির মেয়ে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট লিতুন। তার বাবা হাবিবুর রহমান ওই উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এ আর মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক। 

তিনি ১৮ বছর ধরে কলেজটিতে শিক্ষকতা করছেন। লিতুনের মা জাহানারা বেগম গৃহিণী। জন্ম থেকেই লিতুন জিরার দুটি পা নেই। দুই হাতও নেই কনুইয়ের ওপর থেকে। তবু লেখাপড়ার অদম্য চেষ্টা মেয়েটির। লেখার জন্য ডান হাতের বাহুর আগা দিয়ে কলম চেপে ধরে চোয়ালে। এভাবে লিখেই কৃর্তিত্বের সঙ্গে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে পড়াশুনা করছে মাধ্যমিকে। এবার সে উপজেলার গোপালপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জেএসসি পরীক্ষা দেবেন। এর আগে, ২০২০ সালের খানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পাওয়ার সঙ্গে বৃত্তি পায় লিতুন জিরা। 

লিতুন জিরা শুধু পড়াশোনাতে কৃর্তিত্ব অর্জন করেছে তা কিন্তু নয়! পাশাপাশি সে টানা দ্বিতীয়বারের মতো রচনা প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে পুরস্কার লাভ করেছে। এছাড়াও আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কান প্রতিযোগিতায় নিজের পারদর্শিতা দেখানোর পাশাপাশি খুলনা বেতারেও নিয়মিত গান ও কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছে সে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন জানতে পেরে খুশি লিতুন জিরা। তিনি বলেন, খবরটি প্রথমে আমার বাবাই প্রথম দিয়েছে। শুধু আর্থিক সহায়তায় না, একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সরাসরি দেখাও করতে পারব আমি। আমার যে কত খুশি লাগছে! আমার স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণে আমি ও আমার পরিবার সংগ্রাম করে যাচ্ছি। সেই সংগ্রামে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাশে পেয়েছি। প্রতিবন্ধীদের প্রতি খুবই আন্তরিক এমন একটি প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি আমরা। 
 
লিতুন জিরার বাবা হাবিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, লিতুন খুবই মেধাবি। ছোটবেলা থেকেই উদ্যমী। কিছু করার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ। সেই আগ্রহ আর পরিশ্রম সংগ্রামীর মধ্যে দিয়ে সে আজ অনেকপথ এগিয়েছে। ওর হাতের লেখা সুন্দর। ভালো ছবিও আঁকতে পারে। কবিতা আবৃত্তি করতে পারে। গান গাইতে পারে। পড়াশোনাতে সে আর পাঁচ-দশটি মেয়ের মতো ভালো। পিএসসিতে জিপিএ-৫ সঙ্গে বৃত্তি পেয়েছে। সেই ধারাবাহিকতা আশা করি সে ধরে রাখবে। সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। ও যত দূর পড়তে চায়, আমি ওকে তত দূর পড়াব।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পাঁচ লাখ টাকার অনুদান দেবেন বলে একটি চিঠি এসেছে বাড়িতে। একই সঙ্গে বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পিএস আমার সাথে কথা বলেছে। রোববার সেই চেক লিতুনের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে প্রদান করবেন। প্রতিবন্ধীদের প্রতি আন্তরিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিতুনের পাশে দাঁড়ানোই শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান তিনি। 

এক প্রশ্নের জবাবে হাবিবুর রহমান বলেন, লিতুনের বর্তমানে প্রচুর খরচ। সে নিজে চলাফেরা করতে পারে না। তাই তার একটি গাড়ির দরকার সবসময়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া অর্থসহায়তার টাকায় তার চলাফেরার জন্য একটি গাড়ি ও পড়াশোনার জন্য কিছু টাকা তিনি সঞ্চয় রেখে ভর্বিষ্যতে কাজে লাগাতে চান বলে জানান।
  
লিতুন জিরার পাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে আসায় ভীষণ খুশি মা জাহানারা বেগম। লিতুনের কিছুটা সংগ্রামের কথা স্মরণ করে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, লিতুনের জন্মের পর তাকে দেখে অনেক কেঁদেছিলাম। পরে সিদ্ধান্ত নেই তাকে কারও বোঝা হতে দেব না। সেই পণ থেকে ছোটবেলায় ওকে টুলের সামনে বসিয়ে রাখতাম। টুলের ওপর লেখার স্লেট রেখে হাতে দিতাম খড়িমাটি। খড়িমাটি ডান হাতের বাহুর মাথা দিয়ে ডান চোয়ালে চেপে ধরে নিচু হয়ে মেয়েটা স্লেটে লিখত। এভাবে নিজে নিজেই লেখা শিখেছে। একইভাবে কলম ধরে খাতায় লিখে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে এখন সে মাধ্যমিকে। সে এবার জেএসসি পরীক্ষা দেবে। তার প্রস্তুতিও ভালো। 

এরই মধ্যে জানতে পারলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিতুনের জন্য আর্থিক সহায়তা দেবেন। বিষয়টা জানতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। তবে লিতুন যত বড় হচ্ছে তাকে নিয়ে ততই চিন্তা হচ্ছে আমাদের। পড়াশোনা করলেও তার ভবিষ্যত নিয়ে খুবই চিন্তিত। পড়াশোনা শেষ হলে তার কি চাকরি হবে! বিয়ে হবে কীনা, নানান চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ে আমাদের। তারপরেও লিতুনকে উৎসাহ দেই আমরা। তারে বলি পড়াশোনা করেলে, যোগ্যতা অর্জন করলে একদিন কিছু না কিছু হবেই। এসবের মধ্যে এখন দুই সন্তানের মধ্যে লিতুন জিরাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি বলে জানান লিতুন জিরার সংগ্রামে সব সময় ফুয়েল হিসেবে থাকা জাহানারা বেগম।  

জাহিদ হাসান/এমএএস