কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গোরক মন্ডলে ভূমিহীনদের জন্য তৈরি করা হয় গুচ্ছগ্রাম। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ৩৫৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করে ধু-ধু বালুচরের পাঁচ একর জমিতে ৬০টি টিনশেড ঘর তৈরি করা হয়। কিন্তু চলাচলের রাস্তা, বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকায় কেউ সেখানে থাকতে চায় না।

অসহায় ও ভূমিহীন উপকারভোগীদের জন্য গড়া এই আশ্রয়ণ প্রকল্পটি অপরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করায় দু-একটি পরিবার ছাড়া এটি এখন ফাঁকা পড়ে আছে। প্রকল্প কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে এখানে কেউ থাকছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় বাসিন্দারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, আবাসনটি নির্মাণের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। চারদিকে ঘিরে আছে ধরলা নদী। সেখানে নেই নিরাপদ পানি, বিদ্যুৎ ও যাতায়াতের ব্যবস্থা। সেখানে ৬০টি পরিবারের জন্য কাঁচা টিনশেড ঘর করা হলেও ফুলবাড়ী উপজেলার মাত্র একটি পরিবার আছে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী জেলা লালমনিরহাটের সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের ধরলা নদীতে সর্বস্ব হারানো ১৬টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তারা সবাই ওই ইউনিয়নের চর ফলিমারি গ্রামের বাসিন্দা।

আশ্রয়ণের বাসিন্দা আজিবর রহমান (৮২) ও ছফর আলী (৬৫) জানান, তারা সবাই ধরলা নদীর ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে এই আবাসনে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু চারদিকে নদীঘেরা ও রাস্তাঘাট না থাকায় ওই এলাকায় কেউ যাতায়াত করে না। এই বদ্ধ চরের মাঝে কোনো সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার না থাকায় শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত।

তারা আরও জানান, বন্যার সময় চারদিকে পানি থইথই করে। তখন শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে সেখানে বসবাস করা অনিরাপদ হয়ে ওঠে। চারদিক ফাঁকা হওয়ায় ফলে সামান্য ঝড়ে পড়তে হয় চরম ঝুঁকিতে। প্রতিনিয়ত এ রকম নানা সমস্যা নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, আশ্রয়ণ প্রকল্পটির চারদিকে ধরলা নদী। নদীর মাঝখানের চরাঞ্চলে না করে অন্য কোনো জায়গায় বাস্তবায়ন করলে নদীভাঙা অনেক ভূমিহীন পরিবার সেখানে আশ্রয় নিত। নাগরিক সুবিধা না থাকায় ঘরগুলো নির্মাণের পর থেকে কেউ সেখানকার কোনো সমস্যা নিরসনের ব্যবস্থা নেয়নি। তা ছাড়া প্রকল্পের কাজ নিয়েও শুরু থেকে নানা অভিযোগ রয়েছে। নিম্নমানের কাজ হওয়ায় সামান্য বাতাসেই ঘরের দরজা-জানালা খুলে পড়ে।

পিআইও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দীর্ঘ ৮ বছর থেকে এই উপজেলার দায়িত্বে থাকা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সবুজ কুমার গুপ্তের তত্ত্বাবধানে আশ্রয়ণ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। পাঁচ একর জমিতে ৬০টি টিনশেড ঘরের জন্য ৩৫৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দ করা চালের দাম ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। একই বছরের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়।

প্রকল্পের সাধারণ সম্পাদক সাবেক ইউপি সদস্য হাবিবুর রহমান (হাবিব) জানান,  প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দূরে রেখে নিজেই নামমাত্র কাজ করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন এ কর্মকর্তা। ফলে বসবাসের উপযোগী হয়নি গুচ্ছগ্রামটি। কেউ আসতে চায় না সেখানে। এ ছাড়া জমি অধিগ্রহণের টাকা আমাকে কিংবা অন্যদের সঠিকভাবে দেওয়া হয়নি। জমির টাকা চাইতে গেলে পিআইও দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।

আশ্রয়ের ঘর ফাঁকা পড়ে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে নাওডাংগা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হাছেন আলী বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো সাবেক চেয়ারম্যানের আমলে করা। অপরিকল্পিতভাবে নদীবেষ্টিত একটা দ্বীপ চরের মাঝে হওয়ায় সেখানে কেউ থাকতে চায় না। যেখানে মৌলিক অধিকার ও নাগরিক সুবিধা পাওয়া যাবে না, সেখানে তো কেউ থাকতে চাইবে না।

এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সবুজ কুমার গুপ্ত জানান, গুচ্ছগ্রাম নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ করে সঠিক ডিজাইনে গুণগত মান বজায় রেখে কাজ করা হয়েছে। তবে বসবাস অনুপযোগী হওয়ার বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন দাস জানান, নির্মাণ তার সময়ে না হওয়ায় সে সময়ের অনিয়ম আছে কি না তিনি জানেন না। ওই গুচ্ছগ্রামে লোকজনদের বাস করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

মো. জুয়েল রানা/এনএ