কুমিল্লার আদর্শ সদরে গৃহবধূ মোসা. ফারজানা বেগমকে (২৯) হত্যার ঘটনায় তার স্বামী মো. ইকবাল হোসেনকে (৩৮) গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গতকাল সোমবার (২৫ এপ্রিল) রাতে ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

এ মামলায় ইকবালের বাবা আব্দুল হাকিমসহ আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন র‌্যাব-১১ এর সিপিসি-২ কুমিল্লার কোম্পানি অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন।

এই র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, ইকবালকে গ্রেপ্তারের পর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি পেশায় একজন অটোরিকশা চালক হলেও অটো চালানোর আড়ালে অটোসহ বিভিন্ন গাড়ির ব্যাটারি এবং গাড়ি চুরিসহ বিভিন্ন ধরনের চুরির কাজে সম্পৃক্ততা ছিল। তার নামে গাড়ি চুরির একাধিক মামলাসহ গাড়ির ব্যাটারি চুরির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও তিনি একজন পেশাদার জুয়াড়ি। মূলত জুয়া খেলার টাকা যোগাতেই তিনি চুরিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত হতেন। যার কারণে সঙ্গে তার স্ত্রী ফারজানার প্রায়ই কথা কাটাকাটি ও মনোমালিন্য হতো। তিনি তার স্ত্রী ফারজানাকে নিয়ে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানাধীন অলিপুর গ্রামে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন।

গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় ইকবালের নামে একটি চুরির মামলায় ওয়ারেন্ট জারি হয়। যে কোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন- এমন শঙ্কায় জামিনে বের হওয়ার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে স্ত্রী ফারজানাকে দেন। বলেন,  আমি গ্রেপ্তার হলে তুমি এই পাঁচ হাজার টাকার সঙ্গে তোমার বাবার বাড়ি থেকে আরও কিছু টাকা নিয়ে আমাকে জামিনে বের করবা।

এর কিছু দিন পর চলথি বছরের ১১ মার্চ ইকবাল চুরির মামলার ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। স্বামী জেলে থাকায় স্ত্রী ফারজানা ভাড়াবাসায় শিশু সন্তানকে নিয়ে কী করবে- বুঝতে না পেরে ইকবালের রেখে যাওয়া পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ট্রাক ভাড়া করে বাসার সমস্ত মালামাল নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যান। বাবার বাড়ি থেকে ইকবালকে দেখার জন্য কারাগারে যান। সেখানে বাসা ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যাওয়ার বিষয়টি বলতেই ইকবাল স্ত্রীর ওপর চড়াও হন এবং তাকে দ্রুত ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে বলেন। ফারজানা তাকে কারাগারে ভালোভাবে খাওয়ার জন্য এক হাজার টাকা দিয়ে দ্রুত ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবে বলে আশ্বাস দিয়ে চলে আসেন।

মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন জানান, প্রতিশ্রুতি দিয়েও এ ব্যাপারে কোনো তৎপরতা না দেখানোয় স্ত্রীর প্রতি ক্ষোভের সৃষ্টি হয় ইকবালের। পরবর্তীতে অটোরিকশা মালিকের সহায়তায় এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে জামিন পেয়ে কারামুক্ত হন ইকবাল। সেখান থেকে বোন কলির কাছে যান এবং তার কাছে রেখে যাওয়া মোবাইল ফোন নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যান। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর স্ত্রী কেন তাকে জামিন না করিয়ে বাসার মালামাল নিয়ে চলে এসেছে- সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। স্ত্রী ফারজানা তার মতো জুয়াড়ি ও চোরের সঙ্গে সংসার করবে না বলে জানান। এ নিয়ে ইকবালের সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে ইকবাল শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন তার স্ত্রী যেহেতু তার সঙ্গে থাকবে না, সেহেতু তাকে দুনিয়াতেই রাখবেন না।

পরে ফারজানার কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান ইকবাল। তাকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট করতে থাকেন। ঘটনার দিন ২৩ এপ্রিল তিনি তার স্ত্রী ফারজানাকে ফোন করে বলেন- একমাত্র শিশু সন্তান ফারহানা আক্তার ইভাকে (৭) ঈদের শপিং করে দেবেন। এতে ফারজানা আসতে রাজি হয়। পরবর্তীতে ইকবাল ফারজানাকে আনতে শ্বশুরবাড়ি আলেখারচরে যান। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে নিয়ে জনশূন্য রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রাত সাড়ে ৯টায় পেছন থেকে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করেন ইকবাল। এতে ফারজানা মাটিতে পড়ে যান এবং কান্নাকাটি শুরু করেন। ইকবাল ফারজানার ব্যবহৃত ওড়না দিয়ে মুখ এবং গামছা দিয়ে তার হাত বেঁধে ফেলেন। এরপর একই ইট দিয়ে মাথায় একাধিক আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। সকালে হত্যার বিষয়টি জানাজানি হলে ইকবাল ঢাকায় আত্মগোপনে চলে যান।  

প্রসঙ্গত, গত ২৪ এপ্রিল আদর্শ সদর উপজেলার কালিরবাজার ইউনিয়নের অলিপুর উত্তর কাছার এলাকার পাহাড়ের পাদদেশে  ধানক্ষেত থেকে ফারজানার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি আলেখারচর দক্ষিণপাড়া এলাকার  মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের মেয়ে। এ ঘটনায় তার বাবা কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় ইকবালকে প্রধান আসামি করে সাতজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। 

অমিত মজুমদার/আরএআর