পাহাড়ে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার
পাহাড়, ঝিরি, ঝর্ণা ও সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদ নিয়ে গঠিত পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। পাহাড়ের দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পাহাড়ের জনজীবন সমতলের চেয়ে আলাদা। পার্বত্য অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা টিলা ও পাহাড়ি ভূমি নিয়ে গঠিত। তাই সমতলের জনজীবনে পানির সংকট খুব একটা চোখে না পড়লেও পাহাড়ের জনজীবনে বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রবল।
গ্রীষ্মের শুরু হতেই তীব্র পানির সংকট দেখা দেয় পার্বত্য জেলা রাঙামাটির পাহাড়ি গ্রাম ও দুর্গম অঞ্চলগুলোতে। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঝিরি ও ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করে জীবনযাপন করলেও শুষ্ক মৌসুমে এসব ঝর্ণা পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। ফলে তীব্র পানির সংকটে পড়ে পাহাড়ি গ্রামগুলোর শত শত পরিবার। আশপাশে পানির উৎস না থাকার ফলে প্রতিদিন হেঁটে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয় এসব গ্রামের বাসিন্দাদের। নিত্য ব্যবহারের পানি তো বটেই, পাশাপাশি সুপেয় নিরাপদ পানির সংকটে ধুঁকতে থাকে পাহাড়ি পল্লীগুলো। কুয়া খনন করে বা শুকিয়ে যাওয়া ছড়া থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করার ফলে অনেকে আক্রান্ত হন পানিবাহিত রোগে।
বিজ্ঞাপন
বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নের মিতিঙ্গাছড়ি গ্রামের বাসিন্দা বর্ণা চাকমা। নিজের গ্রামে সুপেয় পানির উৎস নেই। প্রতিদিন পরিবারের সদস্যদের জন্য সুপেয় পানি সংগ্রহ করেন পাশের গ্রাম চেয়ারম্যানপাড়া থেকে। সেই গ্রামটিও নদীর ওপারে অবস্থিত। নদীতে পানি আছে তবে খাওয়ার যোগ্য নয়। মিতিঙ্গাছড়ি থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে আধা কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করেন তিনি। শুধু বর্ণা চাকমাই নন, একই গ্রামের আরও ৩৫-৪০টি পরিবারের নিরাপদ পানির উৎস বলতে এই একটি নলকূপ।
জুরাছড়ি উপজেলার দুর্গম মৈদং ইউনিয়নের ভূয়াতলীছড়া গ্রামে ১৫টি পাহাড়ি পরিবারের বসবাস। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর পাথুরে হওয়ায় এই এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের কথা থাকলেও তা আর করা সম্ভব হয়নি। তাই একমাত্র পানির উৎস হিসেবে কুয়ার পানি পান করে আসছে এই গ্রামের পাহাড়ি পরিবারগুলো। তবে কুয়া পাহাড় থেকে নিচু এলাকায় হওয়ায় ৪শ ফুট উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করেন তারা। বর্ষাকালে ছড়া ও কুয়ার পানি ঘোলাটে ও অপরিষ্কার হয়ে পড়ায় সেই সময়ে দুর্ভোগ আরও চরম হয় তাদের।
বিজ্ঞাপন
শুধু রাঙামাটি জেলার দুর্গম উপজেলাগুলোতেই নয়, জেলা শহরের পাশঘেঁষে থাকা ইউনিয়নগুলোতেও দেখা গেছে একই চিত্র। রাঙামাটি সদর উপজেলাধীন কুতুকছড়ি ইউনিয়নের নাড়াইছড়ি গ্রামের ১১৩টি পাহাড়ি পরিবারের একমাত্র পানির উৎস পাহাড়ি ছড়া। শুষ্ক মৌসুমের কারণে ছড়ার পানি শুকিয়ে গেছে। ফলে ছড়ার মাঝখানে ছোট ছোট কুয়া খনন করে পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন এই গ্রামের বাসিন্দারা। কুয়ার পানি ব্যবহার উপযোগী হলেও পান করার যোগ্য নয়। ফলে পানযোগ্য পানির অভাবে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের মুখোমুখি হতে হয় গ্রামবাসীর। পাশাপাশি পানির অভাবে জমিতে সেচ দিতে পারছেন না গ্রামের চাষিরা। শুকিয়ে যাওয়া ছড়া থেকে পানি সংগ্রহ করে হ্যান্ড স্প্রের মাধ্যমে জমিতে পানি ছিটাচ্ছেন চাষিরা।
নাড়াইছড়ি গ্রামের বাসিন্দা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের পাড়াকর্মী শেফালিকা চাকমা বলেন, আমরা খুবই পানির কষ্টে দিন পার করছি। আশপাশের ছড়া ও ঝর্ণার পানি শুকিয়ে গেছে। পুরো গ্রামে কোনো ডিপ টিউবওয়েল কিংবা রিং ওয়েল নেই। এতগুলো পরিবারের পানির চাহিদা কুয়া থেকে মেটানো সম্ভব নয়। গ্রামের পানির সংকট নিরসনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করা উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সাহায্য কামনা করেন তিনি।
গ্রামের দোকানদার চিত্ত চাকমা বলেন, আমাদের গ্রামে এমন পরিবার আছে যারা একটু উঁচু পাহাড়ি টিলাতে থাকে। তারা প্রচণ্ড পানির সংকটের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। প্রতিদিন ১ অথবা ২ মাইল হেঁটে পানি সংগ্রহ করছেন তারা। প্রতিদিনের এই নিদারুণ কষ্ট দ্রুত নিরসনের দাবি জানাই।
বরকল উপজেলার তাগালগছড়া গ্রামের বাসিন্দা পাপ্পু চাকমা জানান, তাদের পুরো গ্রামের ৩১টি পরিবার একটি ছড়া থেকে সৃষ্ট কুয়ার পানির উপর নির্ভরশীল। এই কুয়ার পানিতে ৩১টি পরিবারের ১৫০-২০০ মানুষ পানীয় জলের পাশাপাশি স্নানের কাজ সারেন। পাড়া থেকে ছড়াতে পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হয় আধা কিলোমিটার পাহাড়ি পথ।
এই গ্রামের কার্বারি (গ্রাম প্রধান) শংকর বিজয় কার্বারি জানান, শুষ্ক মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে এই গ্রামগুলোতে তীব্র পানির সংকট দেখা যায়। আবার বর্ষাকালে ছড়ার পানি অপরিষ্কার ও দূষিত হয়ে যায়। তাই এলাকার মানুষের সুবিধায় এলাকায় পানীয় জলের সংকট নিরসনে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ঝিরি-ঝর্ণাগুলো আগে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি-ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যায়। পাহাড়ি প্রত্যন্ত এলাকায় পানির উৎস ঝিরি-ঝর্ণা ও কুয়া। কিন্তু পাহাড়ে এখন নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বন উজাড়ের কারণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে, পানির উৎস কমছে। কারণ, গাছপালা না থাকলে তো পাহাড়ে পানি পাওয়া যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের সুপেয় পানির সংকট সমাধানে পাহাড়ের ভৌগোলিক বিষয়টি মাথায় রেখে সংশ্লিষ্টদের গবেষণার প্রয়োজন।
রাঙামাটি জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এখানে পানির ব্যবস্থা করা সমতলের চাইতে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ। তারপরও আমরা সাধারণ মানুষের কাছে খাবার পানি পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিটি ইউনিয়নে ৫২টি পানির উৎস সৃষ্টি করছি। অর্থাৎ যেখানে রিংওয়েল প্রয়োজন সেখানে রিংওয়েল দিচ্ছি আর যেখানে টিউবওয়েল প্রয়োজন সেখানে টিউবওয়েল দিচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, জেলার দুর্গম সব জায়গায় পানির সমস্যা থাকলেও বরকল ও বাঘাইছড়ির সাজেকে এই সমস্যা তীব্র। যেহেতু পাহাড়ি এলাকায় পানির স্তর পাওয়া খুব কঠিন, তাই পাশের ঝিরি-ঝর্ণা থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা একটি ডিপিপি প্রস্তুত করছি। তারপরও এই জেলায় ৬৩ ভাগ মানুষ সুপেয় পানির আওতায় আছে।
মিশু মল্লিক/আরএআর