৯২ বছরেও কমেনি মাতৃভান্ডারের জনপ্রিয়তা
কুমিল্লার রসমালাইয়ের ঐতিহ্য শত বছরের। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে এর সুনাম। প্রতিবছর ঈদ উপলক্ষে রসমালাইয়ের চাহিদা বাড়ে ব্যাপক হারে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। ক্রেতাদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মাতৃভান্ডার কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে রসমালাই নিয়ে বাড়ি ফিরছে ভোজনরসিক মানুষ।
শুক্রবার (৬ মে) সন্ধ্যায় কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুর এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে রসমালাই নেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ক্রেতারা। কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অবশেষে রসমালাই সংগ্রহ করছেন। আবার দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়েও রসমালাই না পেয়ে অনেকে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আবার অনেকে পরের ধাপে নিতে অপেক্ষায় থাকেন।
বিজ্ঞাপন
এদিকে ঈদকে ঘিরে ব্যাপক চাহিদা বেড়ে গেছে। রসমালাই বানিয়ে কূল পাচ্ছেন না কারিগররা। রসমালাই শেষ হয়ে গেলেও অধৈর্য হচ্ছেন না ক্রেতারা। তারা আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরের ধাপে নেওয়ার জন্য। অনেকে আবার পরের দিন আসার কথাও বলে যান।
যে রসমালাইয়ের এত কদর, তার ইতিহাস ও যাত্রা নিয়েও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। কেউ বলছে, কুমিল্লা শহরের মনোহরপুর এলাকায় ১৯৩০ সালে ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামে একটি দোকান প্রতিষ্ঠিত হয়। খনীন্দ্র সেন ও মণীন্দ্র সেন নামের দুই ভাই এই যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে তারা রসের ভেতর ছোট ছোট আকারের মিষ্টি ডুবিয়ে বিক্রি করতেন। তখন এর নাম ছিল ‘ক্ষিরভোগ’। অল্প দিনে এটা খ্যাতি লাভ করে। পরে পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর অবাঙালিরা কুমিল্লায় এসে ক্ষিরভোগকে রসমালাই বলতে শুরু করে। সেই থেকে শুরু।
বিজ্ঞাপন
আবার কেউ বলছে, ১৯০০ সালের দিকে কুমিল্লা অঞ্চলে এর যাত্রা শুরু হয়। ১৯৩০ সালে মাতৃভান্ডার নামে এর রসমালাইয়ের নামডাক শুরু। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শংকর সেনগুপ্তের হাত ধরে এটি বিকশিত হয়। বর্তমানে তার ছেলে অনির্বাণ সেনগুপ্ত ব্যবসা পরিচালনা করেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এই শিক্ষার্থী বংশপরম্পরায় এই ব্যবসার হাল ধরেন।
কুমিল্লায় কোনো পর্যটক বা অতিথি এলে রসমালাইয়ের স্বাদ নেননি, এমন ঘটনা বিরল। কুমিল্লার খাদি বস্ত্রের পাশাপাশি চলে আসে রসমালাইয়ের নামও। বাণিজ্যিকভাবে ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও কুমিল্লার রসমালাইয়ের বেশ চাহিদা রয়েছে।
কুমিল্লার রসমালাই খাওয়ার জন্য সিলেট থেকে কুমিল্লায় এসেছেন ফখরুল ইসলাম। তিনি জানান, কুমিল্লা রসমালাইয়ের সুনাম চারদিকে। অনেক স্বাদ। তাই ঈদের ছুটিতে কুমিল্লায় চলে এসেছি। সারা দিন বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরে সময়মতো রসমালাই কিনতে এসেছি। ৪৫ মিনিট ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জানি না রসমালাই পাব কি না।
ময়মনসিংহ থেকে বন্ধুদের নিয়ে কুমিল্লায় ঘুরতে এসেছেন রাকিব হাসান। তিনি জানান, অনেক বছর ধরে কুমিল্লার রসমালাইয়ের খ্যাতি শুনেছি। কিন্তু কোনো দিন খাওয়া হয়নি। এত দীর্ঘ লাইন দেখে ভেবেছি ফিরে যাব। তবে মানুষের আগ্রহ দেখে লাইনে দাঁড়িয়ে যাই। দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর অবশেষে রসমালাই পেয়েছি।
ক্রেতা নাদিম হায়দার চৌধুরী জানান, রসমালাই কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন। এর সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে।
গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা সফরে এসেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল বরার্ট মিলার। টুইটে তিনি লেখেন, ‘কুমিল্লা ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না, যদি না সেখানে গিয়ে রসমালাই খাওয়া হয়। কুমিল্লার প্রাচীনতম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় রসমালাইয়ের দোকান মাতৃভান্ডারের মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ করে আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছি।’
কুমিল্লা মাতৃভান্ডারের সেলস ম্যানেজার পিন্টু চন্দ্র রায় বলেন, প্রায় ৯২ বছর ধরে কুমিল্লা মাতৃভান্ডারের রসমালাই মান বজায় রাখার কারণে এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। আমরা কোনো ক্রেতাকে ফেরত পাঠাই না। ঈদ উপলক্ষে চাহিদা বেড়ে যাওয়া দীর্ঘ সারি সৃষ্টি হচ্ছে। চাহিদা বেড়ে গেলে আমরা উৎপাদন বাড়িয়ে দিই। বর্তমানে জনপ্রতি চার থেকে পাঁচ কেজির বেশি দেওয়া হচ্ছে না।
বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যটক মাতৃভান্ডারের রসমালাই খেয়ে সুনাম করেন বলেও জানান পিন্টু চন্দ্র। তিনি বলেন, আমাদের সরবারহ করা দুধে কোনো ভেজাল থাকে না। মান যাছাইয়ের জন্য উন্নত প্রযুক্তির মেশিন রয়েছে আমাদের।
ভেজালের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আসল রসমালাইয়ের স্বাদ। যে স্বাদ, গুণ আর ঐতিহ্যের কারণে রসমালাইয়ের খ্যাতি দেশ-বিদেশজুড়ে ছড়িয়েছে, সেই রসমালাই ভেজাল আর নকলের ভিড়ে জৌলুস হারাতে বসেছে। তাই আসল রসমলাইয়ের স্বাদ পেতে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ের মনোহরপুরে আসতে হবে।
তাই মহাসড়কের পাশে মাতৃভান্ডার লেখা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কুমিল্লার শহরের মনোহরপুরে আমাদের একমাত্র দোকান। দেশে আমাদের আর কোনো শাখা নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে আমাদের নাম ব্যবহার করে যারা রসমালাই বিক্রি করছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিখ্যাত রসমালাই বানানোর প্রক্রিয়াও হিসাব করে করা হয়। ১ মণ দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষির তৈরি করে তাতে ছোট গুটি বা শুকনো রসগোল্লা দিয়ে ১৪ কেজির মতো রসমালাই বানানো যায়। ১ মণ দুধে এর বেশি তৈরি করলে রসমালাইয়ের আসল স্বাদ নাকি আর থাকে না।
এ বিষয়ে প্রধান কারিগর তপন চন্দ্র দে বলেন, ৩৯ বছর ধরে আমি মাতৃভান্ডারের রসমালাই বানাচ্ছি। ছোট ছোট আকারের রসগোল্লাকে চিনির সিরায় ভিজিয়ে তার ওপর জ্বাল দেওয়া ঘন দুধ ঢেলে বিশেষ পদ্ধতিতে রসমালাই বানানো হয়। এমন একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে। এ ছাড়া মাতৃভান্ডারে দই, ছানামুখী, স্পঞ্জ রসগোল্লা, লেডিকিনি, কালোজাম মিস্টি পাওয়া যায়।
মাতৃভান্ডারের স্বত্বাধিকারী অনির্বাণ সেনগুপ্ত বলেন, ঈদ উপলক্ষে রসামলাইয়ের ব্যাপক চাহিদা। তবে দুধ সরবরাহকারীদের অনেকে ঈদের ছুটিতে আছেন। তাই চাহিদা অনুযায়ী রসমালাই বানানো যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে প্রতি কেজি রসমালাই বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকায়। প্রতিদিন গড়ে মাতৃভান্ডার থেকে এক থেকে দেড় টন রসমালাই বিক্রি হয়।
এনএ