রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে ওঠায় তিন যাত্রীকে জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরিদর্শক (টিটিই) শফিকুল ইসলাম। এরপর রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশে তাকে বরখাস্ত করা হয়। শুরু হয় দেশুজুড়ে সমালোচনা। তারপর রেলমন্ত্রীর নির্দেশে শফিকুলকে আবার দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের দুই দিন পর গতকাল মঙ্গলবার কাজে যোগ দেন শফিকুল। চিলাহাটিগামী রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেনে দায়িত্ব পালন শুরু করেন তিনি। পরে বিকেলে সীমান্ত এক্সপ্রেসে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত তিনি দুই ট্রেনে বিনা টিকিটে ওঠা যাত্রীদের কাছ থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন। 

রেলমন্ত্রীর আত্মীয়কে জরিমানা করে সারা দেশে আলোচনার জন্ম দেওয়া শফিকুলের পারিবারিক অবস্থা জানতে তার গ্রামের বাড়িতে যায় ঢাকা পোস্ট। তার বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার সারুটিয়া গ্রামে। এ গ্রামের রজব আলী শেখ ও শুকজান নেছা দম্পতির ছেলে শফিকুল। ২ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে শফিকুল সবার বড়।

বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায়, আঙিনায় বসে তার বাবা ছাগলের জন্য ঘাস কাটছেন। একটু আগে চাষের জমিতে কাজ শেষে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। শফিকুলের মা ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। বাড়িতে এ দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। তিন কক্ষের একটি টিনের ঘর ছাড়া এ বাড়িতে আর তেমন কিছু নেই।

শফিকুলের বাবা রজব আলী শেখের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের পৈতৃক কোনো সম্পত্তি ছিল না। ছোট বেলায় অন্যের বাড়িতে খেয়েপরে বড় হয়েছেন রজব আলী। বিয়ের পর ১৪ শতক জমি কিনে ওই জমিতে টিনের ঘর করে সংসার শুরু করেন তিনি। দিনমজুরের কাজ করে দুই ছেলেকে মানুষ করেছেন। এক বেলা খেয়ে আরেক বেলা উপোস থেকে স্কুলে গেছে শফিকুল ও তার ভাই।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে টিউশনি করতেন শফিকুল। তখন থেকে তার পড়াশোনার খরচ নিজেই চালিয়েছেন। বাবার ওপর বোঝা হতে হয়নি তাকে। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট ভাইকেও লেখাপড়া করিয়েছেন টিউশনির টাকা দিয়ে।

শফিকুল নবগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাস করেন। তারপর পারিবারিক কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে ২০০৬ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে ২০১২ সালে অনার্স এবং ২০১৩ সালে মাস্টার্স শেষ করেন। অনার্সে পড়া অবস্থায় চাকরি পান বাংলাদেশ রেলওয়েতে ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরিদর্শক (টিটিই) হিসেবে।

ব্যক্তিজীবনে এক মেয়ে ও এক ছেলের জনক শফিকুল। তার মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী আর ছেলে পড়ে ক্লাস ওয়ানে। গ্রামের বাড়িতে তিনি থাকেন না। স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঈশ্বরদী শহরের পূর্বটেংরি পাড়ার কেন্দ্রীয় গোরস্তানের পূর্ব পাশে ভাড়া বাড়িতে থাকেন তিনি।

৯ বছর রেলওয়েতে চাকরি করছেন শফিকুল। চাকরির টাকা দিয়ে জমি-জমা কিছু কিনতে পারেননি। বাবার ভিটায় একটা ভালো ঘরও নির্মাণ করতে পারেননি তিনি।

রজব আলী শেখ জানান, তিনি এখন অন্যের জমি ইজারা নিয়ে চাষাবাদ করেন। নিজেদের কোনো জমি নেই। কিছুদিন হলো, আয় বাড়াতে গরু-ছাগল লালনপালন করেন তিনি।

ছেলে শফিকুলের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রজব আলী বলেন, তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তের খবরে আমি কোনো টেনশন করিনি। কারণ, আমি জানি, আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি। সে তার দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু আমাদের দুঃখ একটাই, আমার সৎ ছেলেটাকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। তাকে নিয়ে আমিসহ গ্রামের সবাই গর্ব করি। শফিকুল আমাদের গর্বের সন্তান। তার কাজে আমরা খুশি।

শফিকুলের মা শুকজান নেছা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলে মানুষের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার, খারাপ কথা বা মারামারি করে মানুষ হয়নি। গ্রামের কোনো মানুষ তাদের খারাপ বলবে, সে সুযোগ দিইনি। আমার ছেলে খুব কষ্ট করে পড়ালেখা করেছে। শফিকুল লেটারসহ এসএসসি পাস করার পর বিভিন্ন কলেজের স্যাররা আমার ছেলেকে কলেজে নেওয়ার জন্য বাড়িতে আসেন।

শফিকুলের দাদি বলেন, আমার নাতিরা অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে। তারাও প্রাইভেট পড়িয়ে লেখাপড়া শিখে চাকরি করছে। আমার শফিকুল খুব ভালো। তার মতো ভালো ছেলে গ্রামে আর নেই।

সাংবাদিক দেখে কয়েকজন প্রতিবেশী শফিকুলদের বাড়িতে আসেন। তাদের একজন সাইফুল ইসলাম জানান, শফিকুলের বাবা সন্তানদের কখনো ভালো পোশাক-আশাক দিতে পারেননি। তারা ভালো ছাত্র ছিল, টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ নিজেরা চালিয়েছে। শফিকুলের সঙ্গে যে কাজটি করা হয়েছে, সেটা অন্যায়। সে যদি অসৎ হবে, তাহলে তাদের এই জীর্ণ-শীর্ণ বাড়িঘর থাকার কথা নয়।

শফিকুলের ছাত্র রাকিবুল ইসলাম বলেন, আমি দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় শফিকুল স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়েছি। তখন দেখেছি অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও সততার সঙ্গে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজে ও ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন তিনি। তিনি সততার সঙ্গে চাকরি করেন। স্যারের সঙ্গে যেটা ঘটেছে, সেটা আসলে ঠিক হয়নি। সরকারের কাছে দাবি, তাকে যেন চাকরিতে বহাল করার পাশাপাশি পুরস্কৃত করা হয়।

আরেক ছাত্র রমিজ আহমেদ বলেন, স্যার আমাদের মাত্র ১০০ থেকে ২০০ টাকায় প্রাইভেট পড়াতেন। এলাকার সবাই তাকে সম্মান করেন। আমরা মনে করি বরখাস্ত করে তার ওপর অবিচার করা হয়েছিল।

সারুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যতটুকু জানি, তারা মানুষ হিসেবে খুবই ভালো। একজন মানুষ খারাপ হলে তার বাহ্যিক কিছু নিদর্শন দেখা যায়। শফিকুলের তেমন কিছু দেখিনি। আমি তিন দফায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে আছি। তিনি নেশা করেন, এমন অভিযোগ মেনে নিতে পারছি না।

 

রেল নিয়ে শফিকুলের ভাবনা

বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের পর ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের কার্যালয়ে গিয়ে শফিকুলের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট।

বাবা-মায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত শফিকুল বলেন, ‘আমার বাবা-মা খুবই আদর্শবান। তারা আমাকে সব সময় বলেন, অবৈধ আয়ে মাছ-মাংস খাওয়ার চেয়ে সৎ আয়ে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা ভালো। আমি তাদের আদর্শ লালন করে চলতে চাই।’

শফিকুলের আদর্শিক গুরু ছিলেন তার প্রাইভেট শিক্ষক রবী ঠাকুর। প্রিয় শিক্ষককে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘বাবা-মায়ের পাশাপাশি আমি একজন শিক্ষক পেয়েছিলাম। তাকেও আমি আমার আদর্শের অন্যতম দিকপাল মনে করি। তিনি আমাদের শুধু প্রাইভেট পড়াতেন। আমি এসএসসি দেওয়ার আগেই তিনি ভারত চলে গেছেন। কিন্তু আমি তার দেওয়া উপদেশ এখনো মেনে চলি।’

সবসময় বিপদ-আপদে অসহায় মানুষের পাশে থাকার ইচ্ছা শফিকুলের। তিনি বলেন, ‘কেউ কোনো বিপদে পড়লে ছুটে যেতে চাই। মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি। আমি যখন টিউশনি করি, তখন অনেককেই বিনা টাকায় পড়িয়েছি। সেসব ছাত্র এখন মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। মানুষের সেবা করার ইচ্ছা থেকে বেশ কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছি।’

মাদকের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি, আমার খুব একটা চাও খাওয়া হয় না, বিড়ি-সিগারেট তো ছুঁয়েও দেখিনি। এ জন্য আমার গ্রামের মানুষ এখনো আমাকে খুব সম্মান করে।’

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণপরিবহন হলো রেল। লাখ লাখ মানুষ সহজে ও সাশ্রয়ে প্রতিদিন রেলভ্রমণ করেন। ফলে বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা রেল। কিন্তু হচ্ছে উল্টো। বিষয়টি শফিকুলকেও ভাবায়। তিনি রেলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চান।

নিজের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার চেষ্টা থাকবে আমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের। আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে রেলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চাই।’

ইতোমধ্যে রেলের রাজস্ব আদায়ে অবদান রাখছেন শফিকুল। সম্প্রতি রাজস্ব আয়ের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে আমি ন্যূনতম ২ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আদায় করি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৪০ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৫৩০ টাকা, মার্চে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৩৯০ টাকা এবং সবশেষ এপ্রিলে ৩ লাখ ১ হাজার ২৮০ টাকা রাজস্ব আদায় করেছি।

এনএ/জেএস