এবার মোবাইল চোর সন্দেহে নির্যাতনে মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যু
নিহত মাদ্রাসাছাত্র মামুন
যশোরের মণিরামপুরে এবার মোবাইল চোর সন্দেহে নির্যাতনে মামুন হাসান (২২) নামে এক মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তার মৃত্যু হয়।
এর আগে মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা হাত-পা বেঁধে তাকে মারপিট করা হয়। পরে স্থানীয় একটি মসজিদের পাশে তাকে ফেলে রাখা হয়। বুধবার সকালে থানা থেকে পুলিশ নিয়ে মা ছকিনা বেগম মামুনকে উদ্ধার করে মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।
বিজ্ঞাপন
মামুন হাসান উপজেলার খোজালিপুর গ্রামের মশিয়ার গাজীর ছেলে। তিনি মণিরামপুর আলিয়া মাদ্রারাসার আলিম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
এ ঘটনার আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি মণিরামপুরে মোটরসাইকেল ছিনতাইকারী সন্দেহে বোরহান কবির নামে এক কলেজছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি যশোরসহ সারাদেশে আলোচিত হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
মামুনের মা ছকিনা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাত ১১টার দিকে ভাত খেয়ে বাড়ির পাশে খালা রেহেনা বেগমের দোকানে যায় আমার ছেলে। তখন আরমান নামে এক ছেলে মামুনকে ডেকে বাড়ির পাশে হরিহর নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। আরমান সম্পর্কে মামুনের বন্ধু। তাদের দুইজনকে সেখানে দেখে দল বেঁধে লোকজন এসে মামুনকে নদীর পানিতে ফেলে মারপিট করে। সেখান থেকে তুলে আয়নালদের বাড়িতে নিয়ে তাকে পেটায়। খবর পেয়ে গিয়ে দেখি আমার ছেলের মরণাপন্ন অবস্থা। তখন ওরা বলে আমার ছেলে মোবাইল চুরি করেছে। আমি চোরাই ফোন দেখতে চাইলে মেম্বার আমাকে মারতে আসে।
তিনি বলেন, আমার ছেলেরে সিরাজ, মামুন, আলমগীর, আয়নাল, আকের, ইউনুস, মুরাদ, ইসরাইল, আকতারুল, মিন্টুসহ আরও অনেকে মেরেছে। রাত ৩টার দিকে যখন আমার ছেলে মারা যাচ্ছিল তখন ওরা চুরির অপবাদ দিয়ে ওর চুল কেটে দেয়। সকালে আমি থানায় এসে পুলিশ নিয়ে যাই। পরে পুলিশের সাহায্যে ওরে মণিরামপুর হাসপাতালে ভর্তি করি। হাসপাতালের বেডে বিকেল ৩টার দিকে আমার ছেলে মারা যায়।
স্থানীয়রা বলছেন, পূর্বের মোবাইল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামুনের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন আয়নালরা। সেই কারণে মঙ্গলবার রাতে তারা মামুনকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য (মেম্বার) আনিছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মঙ্গলবার রাতে চুরির উদ্দেশে একই গ্রামের আয়নালদের ঘরে উঠতে যায় মামুন ও আরমান নামে দুই যুবক। তখন তারা ধরে মামুনকে ধরে মারপিট করে। রাত ৩টার দিকে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি মামুনের হাত-পা বাঁধা। কয়েকজন নারী ও শিশুরা ছাড়া কাউকে পাইনি। আমি বাঁধন খুলে দিয়ে মামুনের বাড়িতে খবর দিই। প্রথমে কেউ আসেনি। আবারও তাদের খবর দেওয়া হয়। এভাবে সকাল হয়ে যায়। ততক্ষণে পুলিশ এসে পড়ে।
ইনিছুর রহমানের দাবি, মামুন নিজ গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে একাধিকবার বৈদ্যুতিক সেচপাম্প (মোটর), মোবাইল ফোন চুরি করে। আট মাস আগে আয়নালদের একটি ফোন চুরি করে মামুন। তখন সালিশের মাধ্যমে মোবাইল ফেরত দেয় সে।
তবে মামুনের বিরুদ্ধে আর কোনো চুরির প্রমাণ দিতে পারেননি এই ইউপি সদস্য। গত রাতে নির্যাতনের সময় তার কাছে চোরাই কোনো মালামাল পাওয়া যায়নি বলেরও নিশ্চিত করেন তিনি।
এদিকে মামুনের সাথে থাকা আরমানকে মঙ্গলবার রাতে হালকা মারপিট করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আরমানের বাড়ি কদমবাড়িয়া গ্রামে। খোজালিপুর ও কদমবাড়িয়া দুই গ্রামের অবস্থান পাশাপাশি।
উপজেলার কাশিমনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম আহাদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাতে আনিছুর মেম্বার আমাকে বিষয়টি জানান। মোবাইল চুরি করতে গেলে মামুনকে লোকজন মারপিট করে বলে জেনেছি। মামুন কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির ছিল। তবে আমি কখনো ওর বিরুদ্ধে চুরির সালিশ করিনি।
মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক উলফাত-আরা ঢাকা পোস্টকে বলেন , বুধবার সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে মামুনকে হাসপাতালে আনা হয়। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। আমরা রোগীকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলি। কিন্তু স্বজনরা নেননি। পরে বিকেল ৩টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মামুনের মৃত্যু হয়।
মণিরামপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। শুনেছি মামুনকে মারপিট করা হয়েছে। ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। যারা মেরেছে তারা চুরির বিষয়টি বলছে। ঘটনার সাথে জড়িত দুইজনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনাটি অধিকতর তদন্ত চলছে।
জাহিদ হাসান/আরএআর