লাভের চেয়ে ক্ষতি করে যে গাছ
একটি চালকলে শ্রমিকের কাজ করেন আফতার আলী। পাশাপাশি কিছু জমি চাষাবাদ করেই চলে তার সংসার। বসতভিটা আর আবাদি জমির আইলে লাগিয়েছেন ইউক্যালিপটাস গাছ। কয়েক বছর আগে লাগানো ২০টি ইউক্যালিপটাস গাছ বিক্রি করে এবার ছেলেকে মুদি দোকান করে দিয়েছেন তিনি।
গত মৌসুমে জমিতে ধানের ফলন কম হওয়ায় এবার অনেক গাছ কেটে ফেলছেন আফতার আলী। পরে আবার গাছ লাগান। তাহলে কি ক্ষতির দিক না জেনে শুধু লাভের কথা ভেবেই ইউক্যালিপটাস গাছই লাগাচ্ছেন আফতার আলী?
বিজ্ঞাপন
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বেশির ভাগ মানুষ এ গাছের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানেই না। বাড়ির সামনের পরিত্যক্ত জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছেন নীলফামারী সদর উপজেলার পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের আব্দুল মতিন। তিনিও পুকুরপাড়ে লাগিয়ে দিয়েছেন দুই শতাধিক ইউক্যালিপটাস গাছ।
সত্যটা স্বীকার করে আব্দুল মতিন নামের একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় ইউক্যালিপটাস গাছ লাগিয়ে এখন ক্ষতিগ্রস্ত আমি। গাছ বড় হওয়ার পর পাতা পানিতে পড়ায় ক্ষতিকর গ্যাসের সৃষ্টি হয়, যা মাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
বিজ্ঞাপন
আফতার আলী আর আব্দুল মতিনের মতো অনেকেই ইউক্যালিপটাস গাছকে ঘিরে স্বল্প সময়ে বেশি লাভের স্বপ্ন দেখছেন। এ কারণে গত দেড় দশকে অস্বাভাবিক হারে এ গাছে ছেয়ে গেছে নীলফামারী জেলা। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসভূমি, কৃষি জমি―সর্বত্রই এ গাছের ছড়াছড়ি।
দেশের উত্তরাঞ্চলে ইউক্যালিক্টর নামে পরিচিতি ইউক্যালিপটাস গাছের ক্ষতিকর দিকগুলো না জেনেই বেশি লাভের আশায় কৃষকরা এ গাছ লাগান। এমনকি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, বসতবাড়ি, অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, হাটবাজারসহ ফসলের মাঠ এখন শোভা পাচ্ছে ইউক্যালিপটাস গাছে।
সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের আয়তায় জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দুই লক্ষাধিক ইউক্যালিপটাস গাছ রয়েছে। ব্যক্তি ও কৃষকপর্যায়ে এ গাছের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে গত ১০ বছরে। সবকিছু মিলিয়ে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন পরিবেশবিশারদরা।
পরিবেশবাদীরা জানান, ডালপালা বিস্তার ছাড়াও গাছটির মূল থাকে ১৫ মিটার গভীরে। পানি ও খনিজ লবণ শোষণ ছাড়াও এরা অতিরিক্ত পানি শুষে ডালপালায় জমা রাখে। ফলে যে জায়গায় গাছটি লাগানো হয়, সে স্থানটি হয়ে পড়ে পানিশূন্য ও কমে যায় উর্বরতা শক্তি। এতে পানির স্তর নিচে নামাসহ অন্য প্রজাতির গাছের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ে। এসব জানার পরও উত্তরাঞ্চলে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর হিড়িক পড়েছে। এতে এ অঞ্চল একদিন মরু অঞ্চলে পরিণত হতে পারে।
জমির আইল, কৃষিজমি ও পতিত জমিতে লাগানো এ গাছ উপকারের পরিবর্তে ক্ষতিই বেশি করে। ইউক্যালিপটাসের পাতা ও ডালপালা অজৈব পদার্থের মতো কাজ করে কৃষিজমিকে অনুর্বর করে। ফলে ফসলের উৎপাদন কমে যায়। এত কিছু জানার পরও কেন এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত?
এ বিষয়ে কৃষকরা জানান, অন্যান্য গাছের তুলনায় ইউক্যালিপটাস গাছ দ্রুত বড় হয়। এ কাঠের চাহিদা বেশি, কাঠে ঘুণ ধরে না, দামও বেশি। তাই ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণ করেন তারা। তবে আবাদি জমির আইলে ইউক্যালিপটাস রোপণ করায় দিন দিন ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, সেটিও স্বীকার করেছেন তারা।
জেলা সদরের কচুকাটা ইউনিয়নের আদর্শ মানিক নার্সারির মালিক মো. মানিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার এক প্রজ্ঞাপনে দেশে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদন নিষিদ্ধ করে। কিন্তু সরকারি এই নিয়ম-নীতির কথা জানতেন না স্থানীয় নার্সারির মালিকরা। বর্তমানে জেলা প্রসাশন ও বন বিভাগের নিষেধাজ্ঞার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমরা আর ইউক্যালিপটাস গাছের চারা উৎপাদন করছি না। তারপরও গ্রামের বিভিন্ন হাটবাজারে ইউক্যালিপটাসের চারা পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে নীলফামারী সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুস সালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৭০ সালে প্রথম বাংলাদেশে ইউক্যালিপটাস গাছ অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয়। প্রথম দিকে এর ভালো দিকগুলো কৃষকদের মাঝে তুলে ধরা হলে তারা এই গাছ চাষে উদ্বুদ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে গবেষণায় দেখা যায়, গাছটি মোটেও উপকারী নয়, বরং পুরোটাই ক্ষতিকর।
তিনি আরও বলেন, ইউক্যালিপটাস গাছ বেশি পরিমাণে পানি শোষণ করে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যায়। আবাদি জমিতে এই গাছ লাগানোর ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। এ গাছের পাতায় একধরনের পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ থাকে, যা জমির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে।
এ গাছ সম্পর্কে জানতে চাইলে নীলফামারী সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান বলেন, কৃষিজমির পাশে ইউক্যালিপটাস লাগানো মারাত্মক হুমকি। এ গাছের শিকড় অনেক গভীরে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে পানি শোষণ করে। ফলে জমিতে পানি স্বল্পতার জন্য ফলন ভালো হয় না।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ গাছ প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারাসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রাণিকুলের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে আর অক্সিজেন সরবরাহ করে সহায়তা করে। কিন্তু ইউক্যালিপটাস তা করে না। বরং এ গাছ অক্সিজেন গ্রহণ, কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ এবং নাইট্রোজেন নির্গমন করে। আবাদি জমির আইলে এ গাছ থাকলে খেতে পোকামাকড় ও রোগবালাই বেড়ে যায়। ইউক্যালিপটাস গাছ জমির উর্বরতা শক্তি কমিয়ে দেওয়াসহ কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। কৃষি বিভাগ মাঠপর্যায়ে এ গাছ না লাগাতে এবং এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে কৃষকদের নিরৎসাহিত করে যাচ্ছে।
পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর ফারুক বলেন, পরিবেশের জন্য ইউক্যালিপটাস গাছ হুমকিস্বরূপ, এটা বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত। এই গাছ না লাগানোর জন্য সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু মানুষ এটা মানছে না। এখন মানুষকে মানানোর দায়িত্ব সরকারের।
তিনি আরও বলেন, এসব গাছ মানুষ কেন লাগাচ্ছে, তা খুঁজে বের করে নিরুৎসাহিত করতে হবে। আমরা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ইটভাটা উচ্ছেদ করতে পারি, নানা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারি। তাহলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গাছগুলোর ব্যাপারে কেন যত্নশীল আচরণ পাই না? সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে এই গাছ রোপণের প্রবণতা কমে যাবে।
নীলফামারী জেলা বন বিভাগের কর্মকর্তা মাহবুবর রহমান বলেন, পরিবেশ উপযোগী না হওয়ায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০০৮ সালে এক প্রজ্ঞাপনে দেশে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদন নিষিদ্ধ করে। তারপর থেকেই অমরা ইউক্যালিপটাস গাছের চারা উৎপাদন করি না এবং নার্সারির মালিকদের গাছের চারা উৎপাদনে নিষেধ করেছি। বিভিন্ন সময়ে কৃষকপর্যায়ে এ গাছ রোপণে নিরৎসাহিত করছি। তবে জেলায় কী পরিমাণ ইউক্যালিপটাস গাছ রয়েছে, তার পরিসংখ্যান বন বিভাগের কাছে নেই।
এনএ/আরএআর