পঞ্চগড় সদর উপজেলার গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা গ্রাম চান্দাপাড়া। দুই দশক আগেও গ্রামে ছিল মানুষের পদচারণ। মাঠভরা ফসল, পুকুরভরা মাছে ভরপুর ছিল। গ্রামটিতে বংশপরম্পরায় কৃষক, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবীসহ বিভিন্ন পেশার প্রায় শতাধিক পরিবার বাস করত। বিভিন্ন উৎসবে হতো নানা আয়োজন।

এত সামাজিকতা ও সমৃদ্ধি থাকার পরও আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যায় গ্রামটি। তবে ঠিক কবে এই চান্দাপাড়া গ্রাম গড়ে ওঠে, তার ইতিহাস কেউ বলতে পারে না। তবে দেশভাগের আগে ভারত ও বাংলাদেশের বিরাট এলাকাজুড়ে চান্দাপাড়া গ্রামের বিস্তৃতির কথা শোনা যায়।

জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় চান্দগ্রাম দুই অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। এক অংশ ভারতে, অপর অংশ বাংলাদেশের মধ্যে পড়ে। দেশ বদল হলেও গ্রামের নাম বদলায়নি। সব ঠিকভাবে এগোলেও ১৯৯০ সালের পর থেকে শুরু হয় সমস্যা। ভারতের কিছু নাগরিক বাংলাদেশ অংশে ঢুকে চুরি-ডাকাতিসহ স্থানীয়দের মারধর করত। তারা উৎপাদিত ফসল ও গৃহপালিত গরু-ছাগল কেড়ে নিত। এবং ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর নানা অত্যাচার সহ্য করতে হতো গ্রামবাসীকে।

এরপর বাংলাদেশের জনগণ প্রতিবাদ গড়ে তোলে। পরে মারামারি ও দ্বন্দ্বে টিকতে না পেরে ২০০০ সালের দিকে প্রায় ১০০ পরিবার চান্দপাড়া থেকে চলে দূরে বসতি গড়ে। তাই ভারতীয় চান্দাপাড়া টিকে থাকলেও বাংলাদেশের চান্দাপাড়া গ্রামে এখন জনবসতি নেই।

তবে বসতি না থকালেও গ্রামে টিকে আছে প্রায় শত বছরের পুরোনো চান্দাপাড়া জামে মসজিদ। এখন কেউই এই মসজিদে নামাজ আদায় করেন না। তাই মসজিদের ভেতরে বসতি গড়েছে বাদুড় আর চামচিকা। বাসা বেঁধেছে মাকড়সা।

গ্রামের সবাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ায় গ্রামের ঠিক মাঝ-বরাবর নির্মাণ করা হয় একটি জামে মসজিদ। স্থানীয়দের মতে, আশপাশের কয়েক গ্রামের মধ্যে এটিই প্রথম আধাপাকা মসজিদ। মসজিদটি প্রাত্যহিক নামাজের পাশাপাশি ধর্মীয় পাঠশালা হিসেবেও সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, চান্দাপাড়া একটি ঐতিহাসিক গ্রাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে ভারত-বাংলাদেশের মানুষের জন্য হাট বসত। নাম ছিল জয়বাংলা হাট। দুই দেশের নাগরিকরা এই হাটে কেনাবেচা করত। সবার মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু হঠাৎ ভারতীয়রা আমাদের ওপর নানা অত্যাচার শুরু করে। আমাদের সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে যেত। এ কারণে ভয়ে সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।

চান্দপাড়া গ্রামে একসময় বাস করতেন আফাজউদ্দীন (৯২)। তিনি সবার মতো এ গ্রামেই থাকতেন, কিন্তু বাধ্য হয়ে চলে গেছেন। তবু তাকে এ গ্রামে আসতে হয় কারণ এখানে তার কৃষিজমি রয়েছে। জমিতে কাজ সেরে নামাজ আদায় করতে আসেন মসজিদটিতে।

তিনি বলেন, সীমান্তের খুব কাছে চান্দাপাড়া গ্রামটি ছিল অনেক সুন্দর। দুপাড়ের মানুষ কখনোই মনে করত না যে সবাই দুই দেশের। কিন্তু হঠাৎ চুরি-ডাকাতি ও খুন-খারাবি বেড়ে যায় গ্রামে। নিরাপত্তা ছিল না। পাশেই ভারতীয় চা-বাগান। বিশেষ করে ভারতীয় চোর-ডাকাতের উৎপাত ছিল বেশি।

তিনি আরও বলেন, এখনো ওই এলাকা থেকে দিনের বেলায় গরু-ছাগল নিয়ে যায় ভারতীয়রা। তাই গ্রামের লোকজন আস্তে আস্তে আশপাশের গ্রামগুলোয় জমি কিনে বাড়ি করা শুরু করল। এখন আর এই গ্রামে কেউ নেই। কাগজে-কলমে গ্রামের নাম থাকলেও বসতি নেই। আমরা কৃষিজমির কারণে অনেকেই এখানে আসি।

এ বিষয়ে গরিনাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ইউপি) মনোয়ার হোসেন দিপু বলেন, চান্দপাড়া গ্রামটিতে মানুষ শত বছর ধরে বাস করেছে। দুপাড়ের মানুষ মিলে সমাজ তৈরি হয়েছে। এখানে জয়বাংলা হাটে সবাই আসত। কিন্তু ওপারের চোর-ডাকাতের উৎপাতে এপারের মানুষগুলো আর গ্রামটিতে বাস করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে।

বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় সরকার সীমান্ত হাটের উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, দুই দেশের সরকার এই কর্মসূচিতে জয়বাংলা হাটটিকে আবারও চালু করা হলে ঐতিহ্য ফিরে আসার পাশাপাশি দুই দেশের মানুষ উপকৃত হবে। গ্রামের মানুষও তাদের ভিটেমাটি ফিরে পাবে।

পঞ্চগড় সদর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জনাব মাসুদুল হক বলেন, আমরা গ্রামটিকে পরিকল্পিতভাবে দৃষ্টিনন্দন করতে চাই, যাতে সাধারণ মানুষসহ দর্শনার্থীরা গ্রামটিকে দেখতে যায়। গ্রামটিকে ইকো ট্যুরিজমের আওতায় এনে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা গ্রামটির মসজিদটিকে আগামী অর্থবছরে সংস্কারের ব্যবস্থা করব।

এনএ