কুড়িগ্রামের রৌমারীতে ছয় দিন ধরে টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। চলমান বন্যায় বাড়ির উঠোন কিংবা ঘরে পানি না উঠলেও চারপাশের রাস্তাঘাট তলিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে তারা।

চলাচলের জন্য নৌকা ও কলাগাছের ভেলা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে হচ্ছে শিশু, কিশোর ও বৃদ্ধদের। বিশেষ করে ভারী বর্ষণ ও হঠাৎ সৃষ্ট বন্যায় মাঠে থাকা খড় পানিতে ভেসে যাওয়ায় গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, রৌমারীতে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা সৃষ্ট বন্যায় ২ হাজার ৬৩ হেক্টর ফসল পানির নিচে নিমজ্জিত রয়েছে। এর মধ্যে ভুট্টা, তিল ও পটলক্ষেতসহ আউশ ব্রি-৪৮ ধান রয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়বেন।

বালুর চর গ্রামের কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, ৪০ হাজার টাকা খরচ করে পাঁচ বিঘা জমিতে আড়াই মাস বয়সী ধান আউস ব্রি-৪৮ লাগাইছি। হঠাৎ বন্যায় সেই ধানক্ষেত পানিতে ডুবে ধান পচে গেছে। খরচের টাকা তুলব কীভাবে এখন? না পেলাম খড়, না পেলাম ধান। আমার কী হবে এখন?

গোয়াল গ্রামের কৃষক মজিবুর রহমান বলেন, আমি তিন বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। পাঁচ-ছয় দিন ধরে পাট পানির নিচে ডুবে আছে। আরও কয়েক দিন এভাবে বন্যার পানি বাড়লে আমার পাটক্ষেত পচে যাবে।

পাহাড়তলী গ্রামে জমিলা বেগম বলেন, বন্যা শুরু হলে আমাদের কষ্টের সীমা থাকে না। খাওয়া ও চলাফেরা সবকিছুতেই দুর্ভোগ শুরু হয়। বাড়ির চারদিকে পানি থইথই করছে। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. কাউয়ুম চৌধুরী জানান, রৌমারী বন্যায় প্রায় ২ হাজার ৬৩ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে বন্যায়। পানি দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।

সরকারি সহায়তা ব্যাপারে তিনি জানান, বন্যায় ঘাটতি কিছুটা পুষে নিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি ও আমনে সার-বীজ ও প্রণোদনার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবগত করা হবে।

এদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের পোড়ারচর ও পূর্ব তিন হাজারী গ্রাম প্লাবিত হয়ে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এতে নিম্নাঞ্চলের দুই গ্রামের অন্তত শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

বুধবার (১৫ জুন) দুপুরে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস সূত্রে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্রের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১১৫ সেন্টিমিটার, সদর পয়েন্টে ধরলার পানি বিপৎসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার ও তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ৭৬ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের ৮  নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন জানান, ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সাত দিন ধরে ব্রহ্মপুত্রের পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি অব্যাহত থাকায় যাত্রাপুর ইউনিয়নের সব থেকে নিম্নাঞ্চল
পোড়ারচর ও পূর্ব তিন হাজারী নামের দুটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

এতে পোড়ার চরের ৪০ পরিবার ও পূর্ব তিন হাজারী গ্রামের ৬৫টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পূর্ব তিন হাজারী গ্রামের ৬৫টি পরিবার তিন দিন আগে পানিবন্দি হলেও আজ মঙ্গলবার (১৪ জুন) পানিবন্দী হয়েছে পোড়ার চরের ৪০টি পরিবার। পানিবন্দি এসব পরিবারের অনেকেই মাচা কিংবা চৌকি উঁচু করে রাত যাপন করছে। এসব এলাকার যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যমে পরিণত হয়েছে নৌকা কিংবা কলাগাছের ভেলা।

সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, আমার ইউনিয়নের দুটি গ্রামে শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি যে হারে বাড়ছে, এভাবে বাড়তে থাকলে অন্যান্য এলাকা প্লাবিত হয়ে বন্যা সৃষ্টি হতে পারে।

রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আশরাফুল আলম বলেন, রৌমারীতে চলমান বন্যায় দুর্যোগকবলিত এলাকাগুলোর মানুষের জন্য তিন লাখ টাকার গোখাদ্য ও  শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করেছি। তা দ্রুত সময়ের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবোর) নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, কুড়িগ্রামে আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে বন্যা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। এখনো সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। 

মো. জুয়েল রানা/এনএ