ভাষাসৈনিক মতিউর রহমান বসনীয়া (কাব্যনিধি) আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। সোমবার (২৭ জুন) সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় রংপুরের রাধাবল্লভে নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাশয়ী অবস্থায় ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, সংগঠক ও ইতিহাসবিদ।

মঙ্গলবার (২৮ জুন) বাদ যোহর রংপুর কালেক্টরেট ঈদগাহ ময়দানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। পরে তাকে নগরের মুন্সিপাড়া করবস্থানে সমাহিত করা হবে বলে জানিয়েছেন রংপুর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মাহমুদুর রহমান টিটু।

এ দিকে কাব্যনিধি ভাষাসৈনিক মতিউর রহমান বসনীয়ার মৃত্যুতে রংপুরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বিভিন্ন সংগঠনসহ রংপুর সিটি করপোরেশন ও বিভিন্ন সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী ও ক্রীড়া সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। শোক বার্তায় মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে।  

মতিউর রহমান বসনীয়ার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে সিটির প্যানেল মেয়র মাহমুদুর রহমান টিটু জানান, তিনি একজন লেখক, সংগঠক ও ইতিহাসবিদ ছিলেন। একজন ভাষাসৈনিক ও মানবদরদি মানুষ হিসেবে সর্বমহলে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। এতসব গুণে গুণান্বিত মতিউর রহমান ছিলেন একজন সদালাপী মানুষ।

এদিকে লেখক রানা মাসুদের আলোর দীপ গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, ১৯৩৬ সালের ২৪ জানুয়ারি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ফলগাছা গ্রামে মতিউর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম তছির উদ্দিন বসনীয়া এবং মাতা মরহুমা মানিকজান নেছা। প্রাইমারি স্কুল কেটেছে ফলগাছাতে আর ম্যাট্রিকুলেশন সুন্দরগঞ্জ আব্দুল মজিদ হাই স্কুল থেকে। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পার হন কারমাইকেল কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে। আর চাকরির ফাঁকে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন রংপুর কলেজের নাইট শিফট থেকে।

মতিউর রহমান বসনীয়ার চাকরি জীবনের শুরু সেটেলমেন্ট অফিসে। এরপর ঢোকেন রেজিস্ট্রি অফিসে। সেখানে মোহরার হিসেবে দুই বছর কাজ করেন। এরপর ডিসি অফিসে যোগ দেন। এ সময় তিনি সিভিল ডিফেন্সে বিশেষ ভলান্টিয়ার প্রশিক্ষণ নেন। ঢাকা ও রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সুনামের সঙ্গে চাকরি করে ১৯৮৪ সালে ১০ বছর আগেই অবসরে যান।

মতিউর রহমান বসনীয়া ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক। ভাষা আন্দোলনে ছিল তার সক্রিয় অংশগ্রহণ। তখন তিনি নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছিলেন। সে সময় সালাউদ্দিন নামক তার এক সহযোগীর সঙ্গে বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছিলেন। এর এক পর্যায়ে দুই দিনের জন্য সুন্দরগঞ্জ বন্দর অচল করে রেখেছিলেন। এসব কারণে রোষানলে পড়েন তিনি। গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। অবশ্য স্কুলছাত্র দেখে ২৪ ঘণ্টা আটকে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের করেছিলেন সহায়তা।

মতিউর রহমান বসনীয়ার ৯টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং আরও তিনটির পাণ্ডুলিপি তৈরি আছে। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে ইতিহাসের পাতায় থাকার মতো গ্রন্থ ‘রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও প্রয়োগ রীতি’। এছাড়া রংপুর পরিচিতি, কিংবদন্তির রাজ্য রংপুর, হিজরি মসজিদ ও রংপুরের দীনি দাওয়াত, প্রেমধারা, হোমিও চিকিৎসা সংকেত, শতদল, জীবনের পথে-ঘাটে, মারেফাত জগতের মুসাফির, হজরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রহ.) ও রংপুরের ইসলাম, বহুবচন, খিচুড়ি তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। পুনর্মুদ্রণ না হওয়াতে এসব বইয়ের অনেকগুলোই এখন বাজারে নেই।

১৯৪৬ সালে মুকুল ফৌজ দিয়ে তাঁর সাংগঠনিক হাতেখড়ি। এরপরে সবুজ সেনা, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, কচিকাঁচার আসর, রংপুর লোকসাহিত্য সংসদ, রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদ করেন। প্রতিষ্ঠা করেন অন্বেষা কচিকাঁচার মেলা, রংপুর একাডেমি, রংপুর লেখক সংঘ। 

১৯৮০ সালে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রংপুর লেখক সংসদ গঠন করা হয়। সাহিত্য ছাড়াও তার আরেক ভালোবাসার আঙিনা হোমিওপ্যাথি। তিনি একসময় এ বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং কুড়িগ্রাম হোমিও কলেজ থেকে পাস করেন। অবসর জীবনে তিনি এই হোমিও চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

শুধু লেখালেখিই করেননি, তিনি একজন সম্পাদকও ছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় ১৯৬৪ সালে ‘বুনিয়াদ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের হয়েছিল। এ সময় সাংবাদিকতাও করেছিলেন কিছুদিন। 

সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে ১৯৫৯ সালে যশোরের গৌড়বঙ্গ সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘কাব্যনিধি’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। রংপুর নাগরিক নাট্যগোষ্ঠী পদক ১৯৯৬, রংপুর জেলা প্রশাসন ২০০০, অভিযাত্রিক ২০০৫, অভিযাত্রিক ২০০৭, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রংপুর ২০০৭, রাধাবল্লভ উন্নয়ন উন্নয়ন সংসদ ২০০৯, গাইবান্ধার বন্ধন ২০০৯, সুধীর সংস্কৃতি পদক ২০১০ ও রংপুর পৌরসভার সিটিজেন অ্যাওয়ার্ড, জেলা শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা লাভ করেন।

ব্যক্তিজীবনে মতিউর রহমান বসনীয়া তিন ছেলে ও তিন মেয়ের সন্তানের জনক।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আইএসএইচ