পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট থেকে শরীয়তপুরের মাঝিকান্দি এবং মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ঘাটে নিয়মিত চলাচল করত ১৫০টি স্পিডবোট। গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর শিমুলিয়া ঘাট থেকে আর কোনো স্পিডবোট যাত্রী নিয়ে মাঝিকান্দি ও কাঠালবাড়ী ঘাটে যায়নি। সব যাত্রী সেতু দিয়ে যাওয়ায় শিমুলিয়ার স্পিডবোট ঘাটে নদীর ওপারে যাওয়ার যেন কেউ নেই। 

এতে চরম বিপাকে পড়েছে স্পিডবোট মালিক ও চালকসহ সংশ্লিষ্টরা। এখন শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় যারা পদ্মা সেতু দেখার জন্য আসেন তাদের ডেকে ডেকে স্পিডবোটে তুলে পদ্মা সেতুর নিচে নিয়ে সেতু দেখান এ সমস্ত স্পিডবোটের চালকরা। তবে এতে প্রতিদিন একটা-দুইটা ক্ষেপও মেলে না স্পিডবোট চালকদের। দু-একটি ক্ষেপ মিললেও তাতে মাত্র ২-৩ শ টাকা আয় হয়। আগে যেখানে আয় হতো হাজার টাকা। মূলত ঘুরতে আসা লোকজন নিয়ে অলস সময় পার করছেন স্পিডবোট চালকরা। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা চরম বিপাকে পড়েছেন।

সরেজমিনে শিমুলিয়া স্পিডবোট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে বাঁধা আছে ৫০টিরও বেশি স্পিডবোট। এগুলোর মধ্যে কিছু স্পিডবোটের চালক স্পিডবোট চালাচ্ছেন। তারা ঘাটে দাঁড়িয়ে ‘এই পদ্মা সেতু দেখতে চলেন, টাকা ১০০’ বলে মানুষজনকে ডাকছেন। তবে এতে তেমন সাড়া নেই। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর হাতেগোনা দু-চারজন মিললে স্পিডবোটে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন পদ্মা সেতু দেখানোর জন্য।

অথচ কিছু দিন আগেও এখানে যাত্রীরা এসে স্পিডবোটে ওঠার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তো। ঘাটের স্পিডবোট চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি ক্ষেপ দেওয়া যেত।  এখন সারাদিনে একটি ক্ষেপ পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়েছে। ছুটির দিনে দুই-একটি ক্ষেপ পাওয়া  গেলেও অন্যান্য দিনে পাওয়াই যায় না।

চালকরা বলেন, ঘাটে এসে ক্ষেপতো পাওয়াই যায় না ক্ষেপের আসায় বসে থেকে চা নাস্তা খেয়ে আরও ৫০-১০০ টাকা খরচ হয়। পরিবার পরিজন নিয়ে চরম বিপক্ষে পড়েছেন স্পিডবোট চালকরা। স্পিডবোটগুলো কেনার মতো লোকও পাওয়া যাচ্ছে না। 

স্পিডবোট চালক ওবায়দুল বলেন, আগে শিমুলিয়া ঘাট থেকে কাঁঠালবাড়ী ও মাঝিকান্দি ঘাটে ১৫০টি স্পিডবোট নিয়মিত চলতো। সেতু উদ্বোধনের পর থেকে এখন সব বন্ধ। আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে অতি কষ্টে আছি। আগে ভাড়ায় স্পিডবোট চালিয়ে ন্যূনতম প্রতিদিন ১০০০ টাকা আয় করতে পারতাম। আর এখন দিনে ১০০ টাকাও আয় করতে পারি না।

অপর স্পিডবোট চালক রাকিব হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর মাত্র একটা ট্রিপ মারছি। প্রতিদিন ঘাটে আসি ট্রিপের আশায়।  এসে ট্রিপতো পাই না উল্টো চা-বিস্কুট খেয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা খরচ করে যাই।

ফেরদৌস নামে অপর এক চালক ‘ব্রিজ দেখা ঘুরে আসা ১০০ টাকা’ যাত্রীদের ডাকছিলেন। তিনি বলেন, এখনতো আর কেউ স্পিডবোট দিয়ে ঘাট পার হয় না। ব্রিজ দেখাতে ঘুরতে নিয়ে যাই। ১০০ টাকা করে জনপ্রতি দেয়। কিন্ত প্রতিদিন ট্রিপ মেলে না।

আরভি নামে এক স্পিডবোট মালিক বলেন, ২০ বছর ধরে স্পিডবোট চালাই। আমাদের চারটি স্পিডবোট আছে। ড্রাইভারকে আগে প্রতি ট্রিপে ২৫০ টাকা দিতাম। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটা স্পিডবোট থেকে আগে ১৫০০-২০০০ টাকা পেতাম। এখন একটা চলছে, তিনটা বন্ধ। গত চার দিনে মাত্র একটা ট্রিপ দিছি। এতে মাত্র ৯ শ টাকা পেয়েছি। স্পিডবোটগুলো বিক্রির চেষ্টা করছি। আমার চারটি স্পিডবোটের মধ্যে তিনটির দাম আছে ৮ লাখ টাকা করে। অপরটি ১১ লাখ টাকা। 

চান মিয়া নামে আরেক স্পিডবোট মালিক বলেন, ৮ বছর আগে দুটি স্পিডবোট কিনেছিলাম ১৬ লাখ টাকা দিয়ে। এখনো পুরোপুরি চালান উঠেনি। চেষ্টা করছি স্পিডবোটগুলো বিক্রি করার জন্য। আড়াই লাখ টাকা করে বলে। সেতু উদ্বোধনের পর একটি ট্রিপও মারতে পারিনি। প্রতিদিন ট্রিপের আশায় এসে  চা-পানি খেয়ে টাকা খরচ করে যাই।

স্পিডবোট মালিক মো. আলাউদ্দিন বলেন, পাঁচ বছর আগে আমার স্পিডবোটটি ৯ লাখ টাকায় কিনেছি।  এখনো চালান উঠেনি। করোনায় দীর্ঘদিন স্পিডবোট  বন্ধ ছিল। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এখন পুরো বন্ধের মতো। স্পিডবোট বিক্রির চেষ্টা করছি, কেনার মতো পাইকার পাচ্ছি না যে বিক্রি করব। এখানে কী করব চিন্তায় আছি। 

স্পিডবোট মালিক মমিন বলেন, এক বছর আগে দুইটা স্পিডবোট ২৯ লক্ষ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। এখন মাত্র ৮ লাখ টাকায় বিক্রি করলাম। আরও দুইটা আছে। ওই দুইটা ১৯ লাখ টাকা দিয়ে কিনছিলাম। এখন ছয় লাখ টাকা বলে।

স্পিডবোট ঘাটের ইজারাদার সালাউদ্দিন বলেন, আমাদের স্পিডবোটগুলো বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া বিকল্প আর কিছু নেই। বাংলাদেশেতো আর এত বড় নৌপথ অন্য কোথায়ও নেই। একদিকে স্পিডবোট চালকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এ বছর করোনার কারণে ৯৮ দিন এবং ব্রিজ উদ্বোধন হওয়ায় আমার প্রাপ্ত আরও ৭দিন মোট ১০৫ দিন স্পিডবোট বন্ধ ছিল। সব মিলিয়ে আমি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

আরএআর