চোখের জলে সাদা মানিককে বিদায়
রাস্তার দুই পাশে শত শত মানুষের ভিড়। সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা মেলে সাদা মানিকের। রাস্তার এক পাশে সাদা মানিক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে একটু প্রশান্তি দিতে মমতাময়ী মায়ের মতো বাতাস করছেন এক নারী। আর সাদা মানিককে ঘিরে রয়েছে গ্রামের মানুষ। দেখে মনে হচ্ছে এলাকার সুপরিচিত ও বিখ্যাত কোনো ব্যক্তিকে গ্রাম থেকে বিদায় জানানো হচ্ছে।
গ্রামের সবার নজর শুধুই সাদা মানিকের দিকে। সাদা মানিকও হেলে-দুলে গ্রামের মেঠোপথ ধরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে এগিয়ে চলেছে। বলছিলাম ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের দিনমজুর ময়নুদ্দিন মন্ডলের পালন করা গরু সাদা মানিকের কথা। রোববার (৩ জুলাই) বিকেলে তাকে বিক্রির উদ্দেশ্যে ঢাকার গাবতলী পশুর হাটে নেওয়া হয়। বিদায়কাল সাদা মানিককে পরম আদর-যত্নে পালন করা ময়নুদ্দিনের স্ত্রী আনজিরা খাতুনের চোখে জল এসে যায়।
বিজ্ঞাপন
গ্রামের দিনমজুর ময়নুদ্দিনের টিনের চালার ঘরে বেড়ে উঠেছে সাদা মানিক। দেখতে মাথার দুই পাশে কালো, পুরো শারীর ধবধবে সাদা, খাড়া দুটি শিং, একটু দুষ্টু স্বভাব ও প্রভুভক্ত। এ কারণে আদর করে নাম রাখা হয়েছে সাদা মানিক। এক বছর আগে নিজের পোষা গরু বিক্রি করে পাশের গ্রাম থেকে ফ্রিজিয়ান জাতের এই ষাঁড় গরুটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় কেনেন সদর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের দিনমজুর ময়নুদ্দিন মন্ডল।
বিজ্ঞাপন
তিন বছরে সাদা মানিকের আকার হয়েছে বিশাল। দৈর্ঘ্যে ১১ ফুট, উচ্চতা ৬ ফুট এবং ৯ ফুট গোলাকার সাদা মানিকের ওজন প্রায় ৩২-৩৩ মণ। এই গরুটির দাম হাঁকছেন সাড়ে ১৩ লাখ টাকা।
সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেলেদুলে সাদা মানিক ঢাকার উদ্দেশ্যে অপেক্ষামান ট্রাকের দিকে আসছে। সে সময় তাকে দেখতে গ্রামের শত শত মানুষ রাস্তার দুই ধারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে যে সব থেকে বেশি দেখাশোনা করতেন ময়নদ্দিনের স্ত্রী আনজিরা খাতুন তিনিও বিদায় জানাতে এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তার সঙ্গে এসেছেন। স্থানীয় হাটে দাম না পাওয়ায় সাদা মানিককে নেওয়া হচ্ছে ঢাকায়। তাকে গাবতলী পশুর হাটে বিক্রি করার জন্য নেওয়া হচ্ছে।
পাশের গ্রামের জামাল বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, ময়নুদ্দিন গরিব মানুষ, তিনি দিনমজুরির কাজ করেন। শখ করে একটি গরু পালন করেছেন। তার গরুর মতো এমন গরু আশপাশের কোনো গ্রামে আর নেই। তার যে গরু সেই হিসেবে লোকাল বাজারে দাম পাচ্ছেন না। যার কারণে তিনি তার গরুটিকে ঢাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে যাতে গরুটি ন্যায্যমূল্যে বিক্রি হয় এই কামনা করি।
প্রতিবেশী আলমগীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, গরুর মালিক গরিব মানুষ। তিনি পরের ক্ষেতে খামারে কাজকর্ম করেন। তিনি শখের কারণে এমন একটি গরু পালন করেছেন। সারাদিন মাঠে কাজ করার পর মাঠ থেকেই কাঁচা ঘাস কেটে বাড়িতে নিয়ে যান। তার গোয়ালে যে এত বড় গরু হয়েছে, এটা অবাক করার বিষয়। গ্রামে তার গরুর যে দাম হচ্ছে সেটা অনেক কম। যে কারণে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যেন ন্যায্যমূল্য পান।
ময়নুদ্দিনের স্ত্রী আনজিরা খাতুন ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি এক বছর ধরে এই গরুটা লালন-পালন করেছেন। তার গায়ে কখনো ময়লা হতে দেননি। দিনে তিন বার গোসল করাতেন। তাকে শুধু মাঠের কাঁচা ঘাস, বাড়িতে উৎপাদিত গম, ছোলা ও ধান খাওয়াতেন। গরিব হওয়ায় ভালো কোনো খাবার খাওয়াতে পারেননি। এখন এই গরুটি বিক্রি করে নিজেদের সংসারের খরচ এবং আরও দুটি গরু কেনার আশা তার। তাকে বিদায় দিতেও অনেক কষ্ট হচ্ছে। তারপরও তাকে বিক্রি করতে হবে। এমন কথা বলার সময় তার চোখে জল এসে যায়।
দিনমজুর ময়নুদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক বছর আগে নিজের বাড়িতে পোষা একটি ষাঁড় ২ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করি এবং দুটি ছাগল বিক্রি করে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় গরুটি পাশের গ্রাম থেকে ক্রয় করি। তখন গরুটির বয়স ছিল দুই বছর এবং ওজন ছিল ১০ মণ। বাড়িতে নিয়ে আসার পর প্রাকৃতিক উপায়েই তাকে খাওয়ানো হতো। তার খাবারের তালিকায় ছিল ছোলা, গম, ভুট্টা, ধান এবং কাঁচা ঘাস। গরিব মানুষ হওয়ায় বাজারের দামি কোনো খাবার খাওয়াতে পারিনি। কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করতে কোনো ওষুধও খাওয়ানো হয়নি।
তিনি আরও বলেন, এখন বাজারে এই গরুর মূল্য প্রায় ১০ থেকে ১১ লাখ টাকা। কিন্তু লোকাল বাজারে এর দাম উঠছে সাড়ে ৫ লাখ টাকা। যার কারণে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছি। তাকে ঢাকার গাবতলী হাটে নিয়ে যাব। আশা করি সেখানে সাদা মানিকের ন্যায্যমূল্য পাব।
ঝিনাইদহ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর জেলার ছয় উপজেলায় কোরবানির জন্য ৮৬ হাজার গরু ও ১ লাখ ৯ হাজার ছাগল প্রস্তুত করা হয়েছে। যা জেলার চাহিদা মিটিয়ে পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এদিকে পশু মোটাতাজাকরণে ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার বন্ধে খামারগুলোতে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/আরএআর