কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ধাওয়ায় নদীতে ডুবে মারা যাওয়া ভাই-বোনের মরদেহ উদ্ধারের দুই দিন পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। 

মঙ্গলবার (৫ জুলাই) রাত ৮টার দিকে কাশীপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর সীমান্তে আন্তর্জাতিক পিলার ৯৪২ এর সাব পিলার ৮ এস এর পাশে বিএসএফ-বিজিবি পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। 

এর আগে গত রোববার (৩ জুলাই) দুপুর দেড়টার দিকে ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের পশ্চিম ধর্মপুর সীমান্তের আন্তর্জাতিক মেইন পিলার ৯৪৩ এর মাত্র ৫০ গজ ভারতের অভ্যন্তরে নীলকমল নদী থেকে পারভীনা খাতুন (৮) ও তার ভাই শাকিবুল হাসানের (৪) ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করে ১৯২ ব্যাটালিয়ন সেওটি-১ ক্যাম্পের বিএসএফ ও সাহেবগঞ্জ থানা পুলিশ। 

গত শুক্রবার (১ জুলাই) রাতে ভারতীয় কয়েকজন দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভারত থেকে নীলকমল নদী সাঁতরে বাবা-মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে ফেরার সময় স্রোতের টানে মা ছামিনা বেগমের (৩০) হাত ফসকে হারিয়ে যায় শিশু পারভীনা খাতুন ও শাকিবুল হাসান। তাদের বাবা রহিজ উদ্দিনের (৩৫) বাড়ী পার্শ্ববর্তী নাগেশ্বরী উপজেলার নেওয়াশী ইউনিয়নের মধ্য সুখাতী গ্রামে।

ওই শিশুদের চাচা নেওয়াশী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আজিজুল জানান, তার ভাই রহিজ উদ্দিন ১৫ বছর আগে কাজের সন্ধানে অবৈধভাবে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে যান। কাজ করেন একটি ইটভাটায়। সেদেশেই ওই দুই শিশুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। 

রহিজ উদ্দিন জানান, সর্বশেষ হরিয়ানা রাজ্যের সুলতানপুরের হাসিহেসা ইটভাটায় কাজ শেষে তারা গত শুক্রবার বাড়ি ফিরছিলেন। তাদের কাছে বৈধ কোনো কাগজপত্র না থাকায় নির্বিঘ্নে দেশে ফিরতে তারা দালালদের সঙ্গে ২২ হাজার রুপি চুক্তি করেন। কিন্তু দালালরা তাদের কাছে ৪০ হাজার রুপি নেন। গত শুক্রবার রাতে ভারতীয় দালাল সিরাজুল ইসলাম, নয়ন, ময়না মিয়াসহ আরও কয়েকজন তাদেরকে কোচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ থানার সেউটি-১ সীমান্তে এনে অন্য আরও ২০/২৫ জন নারী, পুরুষ ও শিশুর সঙ্গে একটি বাড়িতে রাখেন। রাত সাড়ে ৯টায় দালালরা কাঁটাতারের বেড়া কেটে তাদেরকে নীলকমল নদীর পাড়ে এনে নোম্যান্স ল্যান্ডে দাঁড় করিয়ে রাখে। নদী সাঁতরে দেশে ফিরতে বলেন তাদের। 

এ সময় তাদের কথার শব্দ শুনে ভারতীয় সেউটি-১ ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্যরা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ধাওয়া করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে দুই সন্তনকে নিয়ে নদীতে লাফিয়ে পড়েন তারা। ভয়ে অন্ধকারে তীব্র স্রোতের টানে ঠিকমতো সাঁতরাতে পারছিলেন না। ভেসে যাচ্ছিলেন ভাটিতে। এক সময় স্ত্রী ছামিনার হাত ফসকে স্রোতের টানে পানিতে ডুবে যায় তাদের দুই সন্তান। সে সময় অনেক খুঁজেও তাদের উদ্ধার করতে পারেননি তারা।  

রোববার নদীতে ভেসে উঠে দুই শিশুর মরদেহ। নদীতে শিশু দুটির ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করে ১৯২ ব্যাটালিয়ন সেওটি-১ ক্যাম্পের বিএসএফ ও সাহেবগঞ্জ থানা পুলিশ। শিশু দুটির পক্ষে বাংলাদেশি কোনো প্রমাণপত্র দেখাতে না পারায় তারা মরদেহ নিয়ে যায়। পরে ওইদিন মৃত সন্তানের মরদেহ ফেরত চেয়ে বিজিবির লালমনিরহাট ১৫ ব্যাটালিয়নের অধীন কাশিপুর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার বরাবর একটি মানবিক আবেদন করেন বাবা রহিজ উদ্দিন।

মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে ফুলবাড়ী উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের পশ্চিম  ধর্মপুর সীমান্তে আন্তর্জাতিক পিলার ৯৪২ এর সাব পিলার ৮ এস থেকে ৫০ গজ ভারতের অভ্যন্তরে জনৈক নারায়ণ চন্দ্র বর্মনের বাড়ির উঠোনে বিএসএফ-বিজিবি বৈঠক শেষে শিশু দুটির মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে বিএসএফ। 

এ সময় ভারতীয় বিএসএফের পক্ষে ১৯২ ব্যাটালিয়নের সেওটি-১, সেউটি-২ ক্যাম্পের বিএসএফ, সাহেবগঞ্জ থানা পুলিশ ও বিজিবির পক্ষে লালমনিহাট ১৫ ব্যাটালিয়নের অধীন কাশিপুর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার ফরিদ, অনন্তপুর ক্যাম্প ইনচার্জ আরফিন, পুলিশের পক্ষে এএসপি সার্কেল সুমন রেজা, ফুলবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুর রহমান, ওসি (তদন্ত) সারওয়ার পারভেজ, নাগেশ্বরী উপজেলার  নেওয়াশী ইউনিয়ন ওয়ার্ড সদস্য আজিজুল ও মেছের আলী উপস্থিত ছিলেন।

বিজিবির লালমনিরহাট ১৫ ব্যাটালিয়নের অধীন কাশিপুর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার ফরিদ উদ্দিন শিশু দুটির মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

রহিজ উদ্দিনের মামা সাইফুর জানান, রাতেই শিশু দুটির মরদেহ দাফন করা হবে।

জুয়েল রানা/আরএআর