ক্রমাগত লোকসানের মুখে ২০১৫ সালে মুরগির খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন শেখ পলাশ। কিন্তু ততদিনে (তিন বছর) তার লোকসান হয়েছে আট লক্ষাধিক টাকা। এত বড় লোকসানে কার্যতই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়নের কালিয়া গ্রামের যুবক শেখ পলাশ।

শুরু করেন ছন্নছাড়া জীবন। স্ত্রী-সন্তান, সংসারের দিকেও রাখতেন না খেয়াল। তিন বছরের বেশি সময় এভাবে কেটে যাওয়ার পর ২০১৯ সালে বড় ভাই রকিবুল ইসলামের পরামর্শে ও পরিবারের অনুপ্রেরণায় গরুর খামার করার চিন্তা করেন। 

বিভিন্নভাবে সংগৃহীত পাঁচ  লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে খামার গড়ে তোলেন। ক্রয় করেন ১০টি গরু। এরপরেই মূলত ঘুরে যায় তার ভাগ্যের চাকা। ১০টি গরু থেকে চলতি বছরে আসন্ন কোরবানি উপলক্ষে তার খামারে বিক্রয়যোগ্য গরু ছিল ৫০টি। ইতোমধ্যে ৪৪টি বিক্রয় হয়েছে। চার বছরের ব্যবধানে একটি গোয়ালঘর থেকে এখন ঘরের সংখ্যা তিনটি।

গরু পরিচর্যার জন্য পলাশের খামারে দুইজন সার্বক্ষণিক কর্মচারী রয়েছেন। পাশাপাশি তিনি নিজেও কাজ করেন। প্রতিটি গরুকে দিনে দুইবার গোসল করানো হয়। খেতে দেওয়া হয় খড়, খৈল, ভুসি ও ঘাস। দিনে খরচ হয় ৭ হাজার টাকা। ৫ মণ থেকে ১৩ মণ পর্যন্ত গরু রয়েছে এই খামারে। গরুর জাতের মধ্যে রয়েছে দেশি, সিন্ধি, শাহীওয়াল ও ফ্রিজিয়ান। 

শেখ পলাশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মায়ের নামে গড়ে তোলা এই খামারে (রিজিয়া এগ্রো) ২০১৯ সালে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ১০টি গরু পালন শুরু করেন তিনি। তিন বছরে আটটি গরু বিক্রি করেই বিনিয়োগের টাকা উঠে লাভ হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। বাকি দুটি গরু রেখে দেন পরের বছরের জন্য। সেই সঙ্গে ক্রয় করেন আরও ১৩টি গরু। আট লাখ টাকা ব্যয়ে সে বছর লাভ হয় দুই লাখ টাকা। ২০২১ সালে ২৫টি গরু থেকে লাভ হয় পাঁচ লাখ টাকা। ২০২২ সালে ৫০টি গরু বিক্রি করে অন্তত ১০ লাখ টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি। 

শেখ পলাশ বলেন, ৭-৮ বছর আগে অনেক বড় মুরগির খামার ছিল আমার। মুরগি ছিল চার হাজারেরও বেশি। কিন্তু অসুখে অনেক মুরগি মারা যায়। বিভিন্নভাবে চিকিৎসা করিয়েও লাভ হয়নি। রোগে মৃত্যু, খাবারের দাম বেশি আবার বিক্রি করতে গেলে দাম কম পাওয়ায় আমার আট লাখ টাকার ক্ষতি হয়। হতাশায় ভেঙে পড়ি। নতুন করে কাজ করার ইচ্ছাই নষ্ট হয়ে যায়। তাই বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতাম, আড্ডা দিতাম, সংসারেও ঝামেলা হত। ২০১৯ সালে বড় ভাই একদিন ডেকে বলে- ‘অনেক তো ঘুরলি, এবার কিছু কর। টাকা-পয়সার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ ভাই জিজ্ঞেস করে ‘মুরগির ফার্ম-ই করবি আবার।’ তখন বলি যে, জীবনে আর মুরগির ব্যবসা করব না। পরে গরুর খামার করতে বললে, রাজি হই। 

তিনি বলেন, প্রথমে ১০টি গরু দিয়ে ব্যবসা শুরু করি। সেই থেকে প্রতিবছর গরুর সংখ্যা বেড়েছে। এ বছর ঈদে ৫০টি গরু প্রস্তুত করি। ৪৪টি বিক্রি হয়ে গেছে, বাকি ছয়টিও বিক্রি হয়ে যাবে। ঈদের পরে নতুন করে ৫০টি গরু ক্রয় করে সামনের বছরের প্রস্তুতি নিব। আল্লাহর রহমতে এখন আমি অনেক ভালো আছি। দুই ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসারে আমার কোনো অভাব নেই। মানুষকে সহযোগিতাও করতে পারছি সামর্থ্য অনুযায়ী। 

লোকসান বা বেকারত্বের কারণে তরুণদের হতাশ না হয়ে যে কোনো কাজে নিয়োজিত হওয়ার পরামর্শ দেন এই সফল উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, ১০ লাখ টাকা খরচ করে অনেকে বিদেশে যান। কিন্তু এই টাকা দিয়েই দেশে থেকে ভালো কিছু করা সম্ভব। স্থানীয় কেউ যদি গরুর খামার গড়ে তুলতে চান সেক্ষেত্রে যেকোনো পরামর্শ ও সহযোগিতার আশ্বাসও দেন শেখ পলাশ। 

পলাশের খামারে গরু দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত মো. হাবুল বলেন, ভোর থেকে গরুর যত্ন নেওয়া শুরু করি। সকালে খাবার খাইয়ে একবার গোসল করাই আবার দুপুরে গোসল করাই। আমাদের এখানে পাঁচ মণ ওজনের কম কোনো গরু নেই। দেশীয় খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে খুব যত্নে আমরা এদের বড় করি। ভালো দামে বিক্রি হলে আমাদের সংসারও ভালো চলে।

স্থানীয় হুশিয়ার ফকির নামে এক ব্যক্তি বলেন, পলাশের সফলতা আমাদের এলাকার মানুষের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক লোকই আসে প্রতিদিন খামার দেখতে। বুদ্ধি পরামর্শ নিতে। পলাশও তার সাধ্য অনুযায়ী তাদের সহযোগিতা করেন। 

বাগেরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. লুৎফর রহমান বলেন, ঈদুল আজহা উপলক্ষে বাগেরহাটে অনেক গবাদিপশু পালন করেছেন খামারি ও স্থানীয়রা। জেলার বেশিরভাগ খামারিই কাঁচা ঘাস ও স্বাভাবিক খাবার খাইয়ে গরু পালন করেন। পলাশের খামারটি অনেক পরিকল্পিত একটি খামার। এ খামারের গরুগুলোও ভালো। আশা করি সামনে এই খামার আরও বড় হবে।

তিনি আরও বলেন, জেলায় এ বছর কোরবানির জন্য ৫০ হাজার গরুসহ ১ লাখ ২০ হাজার গবাদি পশু প্রস্তুত করেছেন খামারি ও গৃহস্থরা। গত দুই বছর মহামারির কারণে খামারিরা ভালো দাম পাননি। তবে এ বছর ভালো দামে কোরবানির পশু বিক্রি হচ্ছে। জেলার কোরবানির পশুর হাটগুলো জমে উঠেছে বলে জানান তিনি।

বাগেরহাট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯টি উপজেলায় এ বছর কোরবানির স্থায়ী হাট বসেছে ১৩টি আর অস্থায়ী হাট বসেছে ১০টি। 

তানজীম আহমেদ/আরএআর