আজ পবিত্র ঈদুল আজহার দিন। সারা দেশে মুসলমানদের আনন্দের দিন। সকালে ঈদের নামাজ পড়ে পশু জবাই করে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ করছে প্রতিটি ঘরে। কিন্তু বিপরীত চিত্র মৌলভীবাজারে। বন্যায় ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেলে মানুষ ওঠে আশ্রয়কেন্দ্রে। তাই তাদের মনে নেই ঈদের কোনো আমেজ। বরং কখন ফিরবেন বাড়িতে, সেই প্রহর গুনছে তারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, আশ্রয়কেন্দ্রে কেউ ঘুমিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। আবার কেউ গরম জলে আলু সেদ্ধ করতে ব্যস্ত। কারও মুখে কথা নেই, মনে শান্তি নেই। বানের জলের মতো ভেসে গেছে প্রত্যেক মানুষের ঈদ আনন্দ‌ও।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার রাবেয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র আশ্রয় নেন মনোয়ারা বেগম। ২৮ দিন ধরে এই আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন তিনি। খাবারের পানির জন্য বোতল নিয়ে যাচ্ছেন পানি সংগ্ৰহের জন্য।

মনোয়ারা বেগম বলেন, আশ্রয়কেন্দ্র জীবনেও ঈদ করিনি। জীবনের একটি দাগ হয়ে গেল। বাড়িঘর সব পানিতে। এখান থেকে গিয়েও কীভাবে বসবাস করব, সেই চিন্তাই করছি। দুই এতিম নাতি আছে। তাদের‌ও পালতে হচ্ছে। এখন খুবই অসহায় অবস্থায় পড়েছি। আমাদের আর ঈদ কী?

কথা হয় শিশু সানজিদার সঙ্গে। ঈদে কোনো পোশাক কিনেছে কি না, জানতে চাইলে সানজিদা বলে, আমরার ঈদের আনন্দ বন্যায় নিছেগি। বন্যায় আমরারে একেবারে শেষ করি দিছে। ঈদ কাপর কিনতাম পারছি না। আমরার ঘর-দুয়ার সবতা ভাঙি গেছে।

মনোয়ারা বেগম কিংবা সানজিদার মতো মৌলভীবাজারের তিনটি উপজেলার বন্যাকবলিত অধিকাংশ এলাকার মানুষের কাছে ঈদের আনন্দের চেয়ে বড় প্রত্যাশা, কবে ফিরকে বাড়িতে। ১২৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষ সীমাহীন কষ্ট ভুগছে দীর্ঘদিন ধরে। এতে তাদের জীবনযাপন হয়ে উঠেছে বিষাদময়। 

অসহায়ত্ব প্রকাশ করে জোছনা বেগম বলেন, ঈদের দিন মানুষ গোস্ত-পোলাও রান্না করে খায়। আমরা খাব ডাল আর আলু। আমাদের কোনো ঈদ নেই। আমরা গরিব। যেভাবে পারতেছি, সেভাবে ঈদ করতেছি। বাচ্চা-কাচ্চাদেও ঈদে কিছু কিনে দিতে পারি নাই। চলতেই তো পারি না।

হাকালুকি হাওর পাড়ের মুর্শিবাদকুরা গ্রামের বাসিন্দা নেহারুন বেগম। বন্যায় ঘর-দুয়ার সব ভেঙে গেছে তার। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে হাকালুকি উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন। প্রায় এক মাস হতে চলল। তিনি বলেন, বন্যার পানি কমার লক্ষণ নেই। তাই বাড়ি ফেরা হয়নি। এবার আশ্রয়কেন্দ্রে ঈদ পার করতে হচ্ছে।

একই আশ্রয় কেন্দ্রে পরিবার নিয়ে উঠেছেন তাজুল ইসলাম। তিনি হাঁস-মুরগি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। বন্যায় হাট-বাজার তলিয়ে যাওয়ায় তিনি এখন বেকার।

ঈদের দিন কীভাবে কাটছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২৪ দিন ধরে আছি আশ্রয়কেন্দ্রে। কাম-কাজ নাই। আশ্রয়কেন্দ্রে আইয়া সরকারি হুখনা (শুকনো) খাবার ও মন্ত্রীর চাউল-ডাউল অতা দুই দিন পাইছি। আর কেউ আমরার খোঁজ নেয়নি। সরকারিভাবে আমরার কেউ খোঁজ নিছে না। আমরা অসহায় হওয়াই-ই আশ্রয়কেন্দ্রে আইছি। হাতে কোনো টাকাও নাই। পুরান কাপড় পরে আছি। ঈদ কিলা কাটব ইতা আপনারাই বুঝইন।

কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে ঘুরে কথা হয় দুর্ভোগে পড়া অনেকের সঙ্গে। তারা জানিয়েছেন, এবারের ঈদুল আজহায় তাদের কোনো আয়োজন নেই। অন্য বছরগুলোয় সাধ্যমতো ঈদ আনন্দ করতেন। কিন্তু এবারের বন্যা তাদের সব সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছে। তাদের মনে ঈদের চেয়েও বেশি জরুরি প্রশ্ন, কবে ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে?

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুলাউড়া জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষের জন্য তিনটি কোরবানি দেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে মাংস রান্না করে বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া আরও অন্যান্য বরাদ্দ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে।

ওমর ফারুক নাঈম/এনএ