চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদীতে হঠাৎ করে প্রচুর মৃত ও অর্ধমৃত মাছ ভেসে উঠেছে। নদীর পানিতে বিকট দুর্গন্ধসহ পানির রঙও পরিবর্তন হয়ে অনেকটা কালো আকৃতি ধারণ করেছে। গতকাল সোমবার (১ আগস্ট) বিকেলের পর থেকে চুয়াডাঙ্গা, দামুড়হুদা ও আলমডাঙ্গা উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদীর বেশ কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করে এ চিত্র দেখা যায়। 

মাথাভাঙ্গা নদীর এমন অবস্থা ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে। মাছ ভেসে আসার খবরে নদীর পাড়ে শতশত নারী-পুরুষ মশারি ও জাল দিয়ে মাছ ধরতে নেমেছেন। বিকেল থেকে ভোররাত পর্যন্ত টর্চ লাইট ও মোটরসাইকেলের লাইট জ্বালিয়ে চলে এই মাছ ধরা। 

এদিকে হঠাৎ মাথাভাঙ্গা নদীতে মাছ ভেসে উঠার বিষয়টি কোনো সাধারণ ঘটনা নয় বলে জানিয়েছে সদর উপজেলা প্রশাসন। নদীতে মাছ না ধরার জন্য এবং এই মাছ না খাওয়ার জন্য সতর্কতা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে এ ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি তদন্তে মঙ্গলবার (২ আগস্ট) বিশেষজ্ঞ দল মাথাভাঙ্গা নদীর বিভিন্ন স্পট পরিদর্শন ও নদীর পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য বিভাগ।

এদিকে মৃত ও অর্ধমৃত মাছ ভেসে উঠতে দেখে বিকেল থেকে সাধারণ মানুষ মাছ ধরার নেশায় নেমে পড়েন নদীর পানিতে। চুয়াডাঙ্গার দৌলতদিয়াড় ও মালোপাড়া এবং আলমডাঙ্গা ও দামুড়হুদা উপজেলায় নদী সংলগ্ন মহল্লাগুলোতে নদীর দুই প্রান্তে শত শত নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরদের বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জাল ও মশারি নিয়ে নদীতে নেমে মাছ ধরতে দেখা যায়।  

চুয়াডাঙ্গা জেলা মৎস্য বিভাগ বলছে, পানিতে অক্সিজেনের সংকট অথবা নদীর কোনো অংশে পাট জাগ দেওয়ার কারণেও মাছ মরার ঘটনা ঘটতে পারে। তবে পানিতে কালো এক ধরনের তেলের স্তরও দেখা যাচ্ছে বলে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিষয়টি জানা যাবে।

আল রোমাজ রাজন নামে এক স্বেচ্ছাসেবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোমবার বিকেলের পর থেকে মাথাভাঙ্গা নদীতে মাছ ভেসে উঠেছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে। শতশত নারী-পুরুষ মাছ ধরার জন্য নদীর দিকে ছুটে যায়। বালতি কিংবা গামলা নিয়ে মাছ ধরে নিয়ে আসে। পুঁটি, টেংরা, তোড়া, বেলে প্রভৃতি দেশীয় প্রজাতির মাছ মরে ভেসে উঠতে দেখা যায়। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তারা মাছ ধরেছেন। পানির রঙ পরিবর্তনসহ প্রচণ্ড দুর্গন্ধ হয়েছে।  

সোহাগ নামে এক যুবক বলেন, গভীর রাত পর্যন্ত আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রচুর মাছ ধরেছি। ছোট ছোট বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ বেশি ভেসে উঠলেও বড় মাছ পাইনি। পানির রঙ অতিরিক্ত কালো এবং দুর্গন্ধময়। কী কারণে এমন হয়েছে আমরাও বুঝতে পারছি না। এমন হলে মাছ সংকট দেখা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

আলামিন মিয়া নামে নদীর পাড়ের এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশির ভাগ ছোট ছোট দেশীয় মাছ ভেসে উঠছে। আবার কেউ দুই কেজি, কেউ তিন কেজি ওজনের মাছ পেয়েছে। কী কারণে মাছ ভেসে উঠছে আমরা জানি না। পানি অনেক দুর্গন্ধ। এর আগে আমরা কখনো এমন দেখেনি। 

মাথাভাঙ্গা নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটির সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সি বলেন, মাথাভাঙ্গা নদীর পানি নানা কারণে দূষিত হচ্ছে। আমরা বারবার বলছি, মাথাভাঙ্গা নদীকে বাঁচাতে হবে। পৌরসভা শহরের আবর্জনা নদীতে ফেলা হয়। ড্রেনের পানি গিয়ে পড়ছে নদীতে। ঠিক কী কারণে এখন মাছ মরছে, সেটা তদন্ত চাই। সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছি।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা রাজিউল ইসলাম বলেন, বিষয়টি শোনার পর নদী পরিদর্শন করা হয়েছে। দামুড়হুদা ও আলমডাঙ্গা উপজেলার বেশ কিছু স্পটে এ রকম অর্ধমৃত-মৃত মাছ ভেসে উঠছে বলে জেনেছি। দামুড়হুদা উপজেলার ব্রিজ থেকে নদীতে দেখা যাচ্ছে পানির ওপর এক ধরণের কালো স্তর। 

তিনি আরও বলেন, এখন বর্ষাকালে বেশিরভাগ মাছ ডিম দেয়। এই সময়ে এভাবে মাছ মারা গেলে আগামীতে মাছ সংকট দেখা দিতে পারে। মঙ্গলবার বিষয়টি সরেজমিনে তদন্ত করা হবে। 

চুয়াডাঙ্গায় জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের সিনিয়র সহকারী পরিচালক রবিউল ইসলাম, প্রচণ্ড গরমের পর হঠাৎ বৃষ্টির কারণে নদীতে অ্যামোনিয়া গ্যাস সৃষ্টি হয়েছে এবং অক্সিজেনের অভাব দেখা দিয়েছে। এ কারণে মাছ মরে ভেসে উঠতে পারে। তাছাড়া মাথাভাঙ্গা নদীর পানি বিভিন্ন কারণে দূষিত হয়ে পড়েছে। আর কোথাও পাট জাগ দেওয়া হয়েছে কিনা সেটাও জানার বিষয়। এ কারণেও মাছ মারা যেতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শামীম ভূঁইয়া বলেন, মাথাভাঙ্গা নদীতে মরা মাছ ভাসার বিষয়টি শুনেছি। এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এই মাছ না খাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানিয়েছি। কী কারণে এমন ঘটছে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে মঙ্গলবার ব্যাপারটি আরও গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা হবে। জেলা মৎস্য বিভাগকে জেলা প্রশাসক স্যার বিষয়টি তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।

চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে পানি দূষণের কারণে এমন ঘটছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাছ ধরা এবং এই মাছ না খাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। জেলা মৎস্য বিভাগ তদন্তের পর এটার কারণ জানাবে। 

আফজালুল হক/আরএআর