আসামি না হয়েও কৃষকের কারাবাস
বাদল মিয়া
জীবনে কোনোদিন ঢাকা যাননি বরগুনা সদর উপজেলার সদর ইউনিয়নের ঢলুয়া গ্রামের কৃষক বাদল মিয়া (৫৭)। তবু ঢাকার একটি ভুয়া শিশু ধর্ষণের মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় ৩৫ দিন কারাবাসে ছিলেন তিনি। এজন্য বরগুনা সদর থানায় কর্মরত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সাইফুল ইসলাম ও নাঈমুর রহমানকে অভিযুক্ত করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন তিনি। একইসঙ্গে অহেতুক কারাবাসের জন্য রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণও দাবি করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
বাদল মিয়ার সংবাদ সম্মেলনের সূত্র ধরে ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর ডাকযোগে ঢাকার শিশু আদালতের প্রেরিত বাদল মিয়ার গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কপি আসে বরগুনার পুলিশ অফিসে। গ্রহণ করার পর এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বরগুনার আদালতে পাঠায় পুলিশ। এরপর সেখান থেকে পাঠানো হয় বরগুনা সদর থানায়।
গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর বাদল মিয়াকে গ্রেপ্তার করেন বরগুনা থানায় কর্মরত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নাঈমুর রহমান। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর টানা ৩৫ দিন কারাবাসের পর চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি জামিনের সাথে মামলা থেকে বাদল মিয়াকে অব্যাহতি দেন আদালত।
বিজ্ঞাপন
জামিনের পাশাপাশি মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আদেশে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত উল্লেখ করেন, যে পরোয়ানার ভিত্তিতে বাদল মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেখানে মামলা নম্বর লেখা হয়েছে জিআর ৪২৫/১৭ ও শিশু ৮৯০/১৮ (ঢাকা)। এ ছাড়াও মামলা দায়েরের সাল ২০১৭ হলেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিচারকের স্বাক্ষরের স্থলে তারিখ দেওয়া হয়েছে ৪ এপ্রিল ২০১৪।
অন্যদিকে বাদল মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর সেই তথ্য ডাকযোগে ঢাকা জজ আদালতের শিশু আদালতে পাঠানো হলেও এ নামের কোনো আদালত নেই বলে চিঠিটি ফেরত আসে। এ ছাড়াও বাদল মিয়ার গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় উল্লেখ থাকা নম্বরে কোনো মামলা বিচারাধীন নেই বলেও নিশ্চিত হন বরগুনার আদালত। তাই বাদল মিয়াকে জামিনের পাশাপাশি মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বাদল মিয়া অভিযোগ করেন, ‘শুধু টাকার জন্য ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় পুলিশের সোর্স সাইফুল ও ইলিয়াস বরগুনা থানায় কর্মরত এএসআই নাঈমুর রহমান ও সাইফুল ইসলামের সাহায্যে আমাকে অস্তিত্ববিহীন মামলায় ৩৫ দিন কারাভোগ করিয়েছেন। তাই আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
এ বিষয়ে বাদল মিয়ার ছেলে রাকিব বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর আমার বাবার জামিন আবেদনের জন্য ওয়ারেন্টের কপি নিয়ে মামলার কাগজপত্র তোলার জন্য আমি ঢাকায় যাই। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় উল্লেখিত আদালত আমি ঢাকার জজ কোর্টে পাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার জজ কোর্টে ৯টি নারী ও শিশু আদালত রয়েছে। প্রতিটি আদালতে ওয়ারেন্টে উল্লেখিত মামলা নম্বর দিয়ে অনুসন্ধান করে জানতে পারি, এ রকম কোনো মামলা ওইসব আদালতে বিচারাধীন নেই। তখন আমি নিশ্চিত হই আমার বাবাকে ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় কারাগারে পাঠানো হয়।’
বরগুনা থানায় কর্মরত এএসআই নাঈমুর রহমান বলেন, ‘ ২০১৮ সালে বাদল মিয়ার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বরগুনা থানায় এসেছে। তখন আমি পিরোজপুরে কর্মরত ছিলাম। আমি বরগুনা থানায় যোগদান করেছি গত বছরের ৬ নভেম্বর। সে হিসেবে আমি যোগদান করার ২ বছর আগেই বরগুনা থানায় বাদল মিয়ার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আসে। তাই আদালতের আদেশ অনুযায়ী বাদল মিয়াকে গ্রেপ্তার করে আমি আইনানুগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাদল মিয়া নিভৃত গ্রামের একজন মানুষ। তিনি বা তার পরিবারের কারও সঙ্গেই আমার কোনোরকম পরিচয় কিংবা যোগাযোগ ছিল না। শুধু গ্রেপ্তারের জন্যই তাকে আমি খুঁজেছি। এখানে আমার কোনো দোষ নেই। তিনি শুধু শুধুই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছেন।’
এ বিষয়ে কথা বলতে এএসআই সাইফুল ইসলামের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও যোগাযোগের চেষ্টা করেও পুলিশের সোর্স সাইফুল ও ইলিয়াসকে পাওয়া যায়নি।
সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কেএম তরিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অন্যসব গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামির মতোই বাদল মিয়াকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এখানে পুলিশের কোনো দোষ নেই। কেননা সব ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয় না পুলিশের।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে বা যারা পুলিশের সঙ্গে প্রতারণা করে একজন নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করেছেন, তাদের খুঁজে বের করতে ইতোমধ্যে আমরা অনুসন্ধান শুরু করেছি। শিগগির তাদের আমরা আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হব।’
সাইফুল ইসলাম মিরাজ/এমএসআর