বলা হয় ঈশ্বরও একদিন নিষ্ঠুর হন, কিন্তু মা তাও হন না। সন্তানের হাসিমাখা মুখ দেখলেই মা ভুলে যান তার সকল গ্লানি আর দুঃখ-বেদনা। সখিনা বেগম সেই মায়েদেরই একজন। সারাক্ষণ কেঁদে কেঁদে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন বিরল রোগে আক্রান্ত ছেলে মো. ইয়াছিনের সুস্থতার জন্য। 

সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে এখন চোখ দুটোই নষ্ট হতে বসেছে ৫০ বছর বয়সী সখিনার। তবুও প্রার্থনা সন্তানের সুস্থতার জন্য, মঙ্গলের জন্য। মায়ের এমন কষ্টে বুকফাটা আর্তনাদ ইয়াছিনেরও। মায়ের সব দুঃখ ঘুচাতে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আকুতি ২৫ বছরের এই তরুণের।

মো. কালাম ও সখিনা বেগম দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে ইয়াছিন তৃতীয়। তাদের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে। তবে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে বসবাস করছেন তারা। সেখানে এক রুমের একটি ভাড়া বাসায় গাদাগাদি করে থাকেন ইয়াছিন ও তার পরিবারের সদস্যরা। 

আর্থিক টানাপোড়েনের সংসারে যখন নুন আনতেই পান্তা ফুরায়, তখন সেই সংসারে একজন অসুস্থ মানুষ মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়! পরিবারের যে ছেলেটা বড় ব্যবসায়ী হয়ে সবার আশ্রয়স্থল হতে চেয়েছিল সেই ছেলেটাই এখন পরিবারের সবচয়ে বড় দুঃখ!

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জীবিকার তাগিদে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে প্রায় ৩০ বছর আগে কামরাঙ্গীরচরে আসেন ইয়াছিনের বাবা মো. কালাম। এরপর সংসার চালাতে তিনি ফেরি করে আতর-সুরমা বিক্রি করা শুরু করেন। কিন্তু এই কাজ করে যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে ছয় সদস্যের সংসারের ঘানি টানা কষ্টকর হচ্ছিল কালামের।

৩৫০০ টাকা ঘর ভাড়া দিয়ে সংসার চালাতে অন্যের কাছে হাত পাততে হতো। তাই বাধ্য হয়ে সন্তানদের একটু ভালো রাখার জন্য অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করেন সখিনা বেগম। এর পাশাপাশি বাড়িতে সেলাইয়ের কাজও করতে থাকেন তিনি। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল তাদের।

এর মধ্যে ২০০৮ সালে ব্রেইন স্ট্রোক করেন ইয়াছিনের বাবা কালাম। প্রায় দুই বছর শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। ইয়াছিন একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করতেন। বাবার অসুস্থতার কারণে সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনার পাশাপাশি মাদরাসায় তিন হাজার টাকা বেতনে দপ্তরির চাকরি নেন তিনি।

তবে বছর পাঁচেক আগে হঠাৎ একদিন ইয়াছিনের হাত-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষা হয় তার। ডাক্তারের কথামতো ওষুধ খেয়েও কোনো উন্নতি হচ্ছিল না ইয়াছিনের। এরই মধ্যে বিয়ে করেন তিনি। তার ছোট্ট একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে। ভেবেছিলেন সাধারণ ব্যথা, ওষুধ খেলেই সেরে যাবে। কিন্তু দিন যতই যায়, ইয়াছিনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে।

ধীরে ধীরে তার হাত-পা ফুলে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে ঢেউয়ের মতো ভাঁজ পড়তে থাকে মাথার চামড়ায়। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় তার। যন্ত্রণায় সারারাত ছটফট করেন ইয়াছিন। তার খাদ্যনালিতেও ঘা হয়ে গেছে।

সন্তানের চিকিৎসার জন্য গ্রামের ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে দেন ইয়াছিনের বাবা। এক ডাক্তার থেকে আরেক ডাক্তারের চেম্বারে ঘুরতে থাকেন সন্তানের রোগের চিকিৎসার জন্য। কিন্তু কোনো ডাক্তারের চিকিৎসাতেই কাজ হচ্ছেনা ইয়াছিনের। এখনও প্রতিমাসে তিন হাজার টাকার ওষুধ লাগে ইয়াছিনের। ঘুমের ওষুধ না খেলে ইয়াছিনের দুই চোখের পাতা এক হয় না।

স্ট্রোক করার পর থেকে ইয়াছিনের বাবারও দুই হাজার টাকার ওষুধ লাগছে মাসে। নিজের চিকিৎসার খরচ যোগাতে কিছুদিন ঘুরে ঘুরে চকলেট বিক্রি করেছেন ইয়াছিন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে সেই কাজও বেশিদিন করতে পারেননি। এখন ইয়াছিনের ছোট ভাই মো. শাহাদাত ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে চকলেন বিক্রি করেন। আর বাবা কালামও ফিরেছেন আতর-সুরমা বিক্রির কাজে।

ইয়াছিন বলেন, ছোট থেকেই দেখছি বাবা-মা আমাদের ভাই-বোনদের জন্য কষ্ট করছেন। আমার স্বপ্ন ছিল বড় ব্যবসায়ী হয়ে বাবা-মায়ের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেব। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা আমার সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। গত দুই বছর ধরে অনেক বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে। সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারি না। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি। পেটে অনেক যন্ত্রণা হয়। হাত-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা করে।

তিনি বলেন, পরিবারের জন্য, আমার ছোট সন্তানের জন্য অনেক কষ্ট হয়। আমার মাথা দেখলে ঘরের মানুষই ভয় পায়। অল্প বয়সেই আমাকে দেখতে বয়স্কদের মতো লাগে। এমন অসুস্থ হবো জানলে আমি বিয়েই করতাম না। চিকিৎসার জন্য মানুষের কাছে এখন হাত পাততে হচ্ছে। কিন্তু মানুষের কাছে হাত পাততে আমার খুব খারাপ লাগে। আমি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। 

ইয়াছিনের মা সখিনা বেগম বলেন, যে চোখে না দেখবে সে আমার ছেলের কষ্ট বুঝবে না। রাত-দিন সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করি ছেলের সুস্থতার জন্য। আমার কষ্ট লাগে, কেন আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করে না। দিন দিন আমার ছেলের শারীরিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। ছেলের চিকিৎসার জন্য গ্রামের ভিটেমাটি বিক্রি করে দিয়েছি। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। এখন আর আমার কোনো সহায়-সম্বল নেই, আমি নিরুপায় হয়ে গেছি। ছেলের চিকিৎসার জন্য সব শেষ করে ফেলেছি। আমিও আর মানুষের বাড়িতে কাজ করতে পারি না।

তিনি আরও বলেন, ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে এখন চোখে দেখি না। চোখে ঠিকমতো দেখতে পাইনা বলে সেলাইয়ের কাজও করতে পারি না। সংসার চালানোর জন্য আমার ছোট ছেলেটা (শাহাদাত) এখন চকলেট বিক্রি করে। মানুষের বাড়ি-বাড়ি যখন কাজ করতাম তখন মনে করতাম ছেলেগুলো বড় হয়ে আমাদের সব কষ্ট দূর করে দেবে। মায়ের সামনে যখন ছেলে যন্ত্রণায় কাঁদে তখন বুকটা ফেটে যায়। আমার ছেলের কষ্ট আমি সইতে পারছি না।

ইয়াছিন Pachydermoperiostosis (প্যাচিডার্মোপারিওস্টোসিস) রোগে আক্রান্ত। এটি জেনেটিক বা বংশগত একটি রোগ। প্রতি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়। বলা যেতে পারে রোগটি বিরল। এ রোগের কারণে যখন তখন শরীরের চামড়ার মধ্যে থিকনেস তৈরি হয়। যখন যে সমস্যা দেখা দেবে সেটার চিকিৎসা করতে হবে। তবে চিকিৎসা ব্যয়বহুল।

সফিক আহমেদ, ডিরেক্টর, ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ

তিনি আরও বলেন, আমার জীবনে এমন বিরল রোগ খুব কম দেখেছি। এটি কোনোভাবেই আরোগ্যযোগ্য রোগ নয়। তবে যখন যে সমস্যা দেখা দেবে সেটিও ওষুধ খেতে হবে।

ইয়াছিন ও তার পরিবারকে কেউ সহযোগিতা করতে আগ্রহী হলে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৮২১-৭৮১৪৮৬ নম্বরে।

এমএএস