বন্দরে ভিড়তে পারছে না জাহাজ-কার্গো, বেকার হচ্ছে ৮ হাজার শ্রমিক

চলতি শুষ্ক মৌসুমে ফরিদপুরে পদ্মা নদীতে আবারও নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। নদীর মাঝে জেগে ওঠা ছোট-বড় অসংখ্য ডুবোচরের কারণে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো ও বড় ট্রলার চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে আসা এসব পণ্যবাহী জাহাজ সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দরে ভিড়তে পারছে না। অচল হতে বসেছে জেলার একমাত্র নৌবন্দর হিসেবে পরিচিত সিঅ্যান্ডবি ঘাট।

এদিকে নৌবন্দরের শুল্ক আদায়ও কমে গেছে। এছাড়াও এসব নৌযান থেকে পণ্য খালাস করতে অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হচ্ছে। পণ্যবাহী নৌযানের মালিকরা ও পণ্য আমদানিকারকরা চরম বিপাকে পড়েছেন। তাছাড়া নৌবন্দর এলাকার প্রায় আট হাজার শ্রমিক বেকার হতে বসেছে। এছাড়াও দিনের পর দিন অরক্ষিত স্থানে জাহাজ, কার্গোগুলো থাকায় পড়তে হচ্ছে বিবিধ সমস্যায়। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ পদ্মা নদীর পানি কমতে শুরু করে। তখন থেকেই এসব নৌযানগুলো নাব্য সংকটের কবলে পড়ে সিঅ্যান্ডবি ঘাটের বন্দরে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে এই দুরাবস্থা চরমে পৌঁছেছে। বর্তমানে নাব্য সংকট রক্ষায় কয়েকটি স্থানে বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজার মেশিন বসিয়ে খনন কাজ করছে। তবে খননের কয়েকদিনের মধ্যেই আবার বালু এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে।

দক্ষিণবঙ্গসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্যবসায়ীক পণ্য আনা নেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ নৌবন্দরটি শত বছরের প্রাচীন। ২০১৭ সালে সরকার এটিকে তৃতীয় শ্রেণির নৌবন্দরের অন্তর্ভুক্ত করে হিসেবে গেজেট প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নৌ পথে এই বন্দরে পণ্য আনা নেওয়া করা হয়। 

ফরিদপুরের সোনালি আঁশখ্যাত পাট এই বন্দর হয়েই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয়। এছাড়াও সিলেট থেকে কয়লা ও বালু, ভারতের গরু ও চালসহ চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মিরকাদিম থেকে এই নৌ পথেই চাল আমদানি হয়। নারায়ণগঞ্জ বন্দর থেকে প্রচুর সিমেন্টবাহী জাহাজ ও কার্গো এই বন্দর থেকে খালাস করা হয়। বর্তমানে নদীতে নাব্য সংকট এবং অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় এসব পণ্যবাহী নৌযান বন্দরে আসতে পারছে না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নৌবন্দরে ভিড়তে না পেরে অনেক দূরে দির্ঘীর চর, ভুঁইয়াবাড়ি ঘাট, খুশির বাজার, বাইল্যা হাটা, হাজিগঞ্জের চর, চরভদ্রাসনের এমপিডাঙ্গি ও গোপালপুরসহ বিভিন্ন স্থানে নদীর তীরে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো ও বড় ট্রলার ভেড়ানো রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাট থেকে আসা এমন একটি সিমেন্টবাহী জাহাজের মাস্টার মো. দুলাল হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, চরভদ্রাসনে এসে ঠেকে গেছি। আমার জাহাজে ১২ হাজার বস্তা সিমেন্ট আনা যায়। কিন্তু পর্যাপ্ত গভীরতা নেই বলে আট হাজার বস্তা আনতে হয়েছে। এতে পণ্যের ভাড়াও কমে গেছে আমাদের। নৌবন্দরে ভিড়তে পারলে প্রতি বস্তা থেকে ১৪ টাকা পেতাম। কিন্তু এখন এই ভাড়ার অর্ধেক দিয়ে আরেকটি ট্রলার ভাড়া করে মাল খালাস করতে হচ্ছে। এসব কারণে আমাদের স্টাফ খরচ এবং অন্যান্য ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এছাড়া জানমালের নিরাপত্তা নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন।

এমবি ছায়ানীড় নামে আরেকটি জাহাজের মাস্টার মো. ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাব্য সংকটে জাহাজের ইঞ্জিনের পাখা ভেঙে যায়। সুখান আটকে যায়। জাহাজের অনেক ক্ষতি হয়। 

তিনি বলেন, নদীতে অন্তত ১০ হাত গভীর পানি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে কোথাও কোথাও দুই-তিন হাত পানি রয়েছে।

ড্রেজিংয়ের পরও নদীতে নাব্যতা আসছে না। এর কারণ জানতে চাইলে সেখানে ড্রেজিংয়ের কাজে নিযুক্তরা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, ড্রেজিংয়ের পরপরই আবার নতুন বালু এসে ভরে যাচ্ছে। পানিতে প্রচুর পলি রয়েছে।

বন্দরের নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. হেলালউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দক্ষিণবঙ্গসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্যবসায়িক পণ্য আনা নেওয়ার জন্য এই নৌবন্দরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বছরের পাঁচ মাসের মতো সময় এখানে পানি কম থাকে বিধায় বন্দরে পণ্য খালাসে জটিলতা সৃষ্টি হয়। 

তিনি আরও বলেন, গত একমাসে পদ্মার বুকে অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে। সেজন্য বন্দরমুখী পণ্যবাহী বেশ কিছু জাহাজ আটকা পড়েছে। শ্রমিকরা প্রায় বেকার হয়ে পড়েছে।

ফরিদপুর নৌবন্দরের পণ্য খালাসে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠান লাকি ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার মো. আব্দুস সালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় আট হাজার শ্রমিক এই নৌবন্দরে কাজ করেন। এর মধ্যে অনেক ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীও রয়েছেন। জাহাজ ও কার্গো না আসায় তারা কাজ পাচ্ছেন না। 

তিনি বলেন, বছরে পাঁচ মাসের মতো সময় এখানে পানি কম থাকে বলে বন্দরে পণ্য খালাসে সমস্যা হয়। ব্যবসায়িকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

নৌবন্দরটি ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়নে অবস্থিত। ডিক্রিরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান মিন্টু ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাব্য সংকটে বন্দরটি অচল হতে বসেছে। বন্দরটিকে ঘিরে হাজার হাজার শ্রমিক-ব্যবসায়ীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছিল। বন্দরটি অচল হলে শ্রমিকরা কাজ হারাবে, ফলে চুরি-ছিনতাই বৃদ্ধি পাবে। 

তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে দ্রুতই ড্রেজার দিয়ে বালু কাটা হলে ঘাটটি সচল থাকবে।

ফরিদপুরের সিঅ্যান্ডবি ঘাট থেকে শুল্ক আদায়কারী বিআইডব্লিউটিএর কর্মচারী মো. নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্দরে জাহাজ, কার্গো ও বড় ট্রলার ভিড়তে না পারায় শুল্ক আদায়ও কমে গেছে। আগে ঘাটটি ইজারা দেয়া হতো। তবে এখন সরাসরি বিআইডব্লিউটিএ এখান থেকে শুল্ক আদায় করছে।

এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট পোর্ট অফিসার মাসুদ পারভেজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নৌবন্দরটিকে সচল করতে নৌচ্যানেলে ড্রেজিং করা হচ্ছে। তবে এখনও পথটি বড় নৌযান চলাচলের উপযুক্ত হয়নি। আশা করছি চলতি মৌসুমেই এই সংকট কেটে যাবে।

আরএআর