টাঙ্গাইলে বছরের পর বছর বন্ধ থাকা চালকল থেকে নিম্নমানের চাল নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে খাদ্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। চালকল মালিকদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে এসব নিম্নমানের চাল বিতরণ করা হয়। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার চালকলগুলো ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলায় ১১টি চালকল মালিকদের কাছ থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও এলএসডি (খাদ্য গুদাম) কর্মকর্তারা চাল সংগ্রহ করেন। এতে বিভিন্ন শর্তে তাদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করার নিয়ম থাকলেও ঘুষের বিনিময়ে চালকল (রাইস মিল) মালিকরা নিম্নমানের চাল বাইরে থেকে কিনে বাড়তি দামে সরকারের কাছে বিক্রি করেন। উপজেলার দু-একটি রাইস মিল ছাড়া সবগুলো রাইস মিলই বছরের পর বছর বন্ধ থাকে। তবে কাগজে কলমে এসব রাইস মিল চালু দেখানো হয়েছে। রাইস মিলের মালিকরা প্রতিবছর সরকার ঘোষিত আমন, বোরোসহ বিভিন্ন জাতের ধানের চাল বিক্রি করছেন। 

অথচ শর্ত অনুযায়ী সরকার চাল সংগ্রহের আগে খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের একজন প্রত্যয়নকারী কর্মকর্তা রাইস মিলে উপস্থিত হয়ে ধান থেকে চাল উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিদর্শন করে চালের প্রত্যয়ন ইস্যু করবেন। যেখানে রাইস মিলগুলোই সচল নেই, সেখানে প্রত্যয়নকারী কর্মকর্তা কীভাবে এই প্রত্যয়ন দিয়েছেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।

সরেজমিনে উপজেলার বাহাদীপুর এলাকার একতা ও ভাই ভাই রাইস, ফলদার মোংলা রাইস মিল, কয়েড়া এলাকার আরাফাত রাইস মিল, মন্ডল রাইস, কাগমারীপাড়ার সরকার রাইস মিলে গিয়ে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে এসব রাইস মিল বন্ধ রয়েছে। মিলগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। তবে মিলের চাতাল থাকলেও সেখানে স্থানীয়রা বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন কিছু শুকানোর কাজ করেন। এসব মিলে  নেই কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ। 

এছাড়াও লুনা নাহিদ, হামিদা মিম, মাহিন তুহিন, মায়ের দোয়া ও আব্দুর রাজ্জাক রাইস মিলে বর্তমানে চিটা ধানসহ মাছ ও মুরগির কুড়া তৈরির কাজ করা হচ্ছে। সেখানে কোনো ধরনের ধান থেকে চাল তৈরি হচ্ছে না। অন্যদিকে হামিদা মিম, মাহিন তুহিন একই চাতালে দুই লাইসেন্সে সরকারকে নিম্নমানের চাল দিচ্ছে। যার মালিক হচ্ছেন শাহজাহান কবির লিটন। এসব চাতাল বন্ধ থাকার সুযোগে স্থানীয় চালের ডিলাররা অন্যত্র থেকে নিম্নমানের চাল কিনে রাইস মিলের মাধ্যমে চাল সরকারকে দিচ্ছে।

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরের গত ডিসেম্বর মাসে উপজেলার ১১টি রাইস মিল থেকে ৩০ কেজি ওজনের ৪ হাজার ৪৮৬ বস্তা আমনের সিদ্ধ চাল সংগ্রহ  করা হয়েছে। গত মে মাসে ৩০ কেজি ওজনের ২ হাজার ৫২৮ বস্তা বোরো ধানের সিদ্ধ চাল সংগ্রহ করে গোডাউনে রাখা হয়। যা প্রত্যেক ডিলারের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এজন্য শর্ত অনুযায়ী মিল পরিদর্শন করে প্রত্যয়নকারী কর্মকর্তা মিল প্রাঙ্গণে উপস্থিত থেকে ধান থেকে চাল উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিদর্শন করে চালের প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করবেন। প্রত্যয়ন ও নমুনা ব্যতীত চাল ক্রয় করা যাবে না। বরাদ্দকৃত চাল কালার সর্টার  প্রযুক্তি ব্যবহার করে এলএসডিতে সরবরাহ করতে হবে। তবে এই শর্তের কিছুই বাস্তবায়ন করা হয় না।

এদিকে গত ঈদের আগে ভিজিএফের আওতায় হতদরিদ্রদের মাঝে ১০ কেজি করে চাল বিতরণের সময় বড় বড় পাথর পাওয়া যায়। এছাড়া চালের প্রত্যেক বস্তাতে ছিল পর্যান্ত পরিমাণে কুচি পাথর। একটি পৌরসভা ও ইউনিয়নগুলোতে পাথরযুক্ত চাল বিতরণ করা হয় দরিদ্রদের মাঝে। চালে পোকা পাওয়ার অভিযোগও ছিল।

চালকল মালিকরা জানান, সরকারে বিভিন্ন শর্তে চাল দিতে গেলে বাড়ির জমি বিক্রি করে দিতে হবে। এছাড়া চাল দিতে গেলেই কর্মকর্তাদের টন প্রতি ২ হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। গোডাউনে লেবার খরচতো আছেই। এতে একজন মিল মালিক ৫০ টন চাল দিতে গেলে এক লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। লাইসেন্স রক্ষার্থে ডিলারদের কাছ থেকে চাল কিনে দেওয়া হয়। তাতে কিছু টাকা লাভ পাওয়া যায়। এভাবেই সারাদেশে চাল দেওয়া হয়। সরাসরি কোনো মিলার গোডাউনে চাল দিতে পারে না।

বাহাদীপুর পূর্বপাড়া গ্রামের একতা ও ভাই ভাই রাইস মিল সংলগ্ন বাড়ির মালিক আকাশ বলেন, কয়েক বছর ধরেই দুটি রাইস মিল বন্ধ রয়েছে। মিলে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। কোনো যন্ত্রপাতিও নেই। তবে মাঝে মধ্যে রাতে চালের বস্তা আসে। দু-একদিন পরেই আবার নিয়ে যায়।

রাইস মিলের পাশের মুরগির খামারের মালিক তোফাজ্জল বলেন, মিল দুটি বন্ধ। তবে দেখাশোনা করার জন্য একজন নিরাপত্তা প্রহরী রয়েছে। তিনিই দেখাশোনা করেন। এখানে চাল তৈরি হয় না।

ফলদার মোংলা রাইস মিলের মালিক আয়নাল বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই রাইস মিলে চাল তৈরি হয় না। বর্তমানে শুধু ধানের চিটা ভাঙানো হয় মাছ ও মুরগির খাদ্য হিসেবে বিক্রির জন্য। খাদ্য অফিসে চাল দেই ডিলারদের কাছ থেকে কিনে। ডিলাররাই চাল গোডাউনে দিয়ে দেয়, আমরা শুধু স্বাক্ষর করি। এতে কিছু লাভ থাকে। তবে আমরা সরাসরি চাল দিতে গেলে বেশি ঘুষ দিতে হয়।

কয়েড়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক রাইস মিলের মালিক রাজ্জাক জানান, বাজারে ধানের যে দাম তাতে ধান ভাঙিয়ে অফিসে খরচ দিয়ে চাল দেওয়া সম্ভব না। লাইসেন্স টিকিয়ে রাখার জন্য এদিক সেদিক  করতে হয়।

অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা আব্দুল হালিম বলেন, চাল সংগ্রহ করার বিষয়টি খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা দেখেন। আমরা কোনো খারাপ চাল নেই না।

উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা কাজী হামিদুল বলেন, মিলাররা সরাসরি খাদ্য গুদামে চাল দেন। সেখানে মিলাররা গোডাউন কর্মকর্তার সঙ্গে কীভাবে চাল দেন সেটা তাদের বিষয়। যাচাই-বাছাই শেষে মিলারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করা হয়। তবে রাইস মিল বন্ধ থাকলে তাদের লাইসেন্স বাতিলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মোহাম্মদ তানভীর হোসেন বলেন, বর্তমানে সরকারের কোনো ধরনের কর্মসূচির চাল বাজারে নেই। ভিজিডি কার্যক্রমও বন্ধ, সুতরাং বাইরে থেকে ডিলারদের কাছ থেকে চাল কেনার সুযোগ নেই। আর রাইস মিলগুলো যদি বন্ধ থাকে তাহলে আগামী আমন মৌসুমের আগে সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা মিল বন্ধ থাকার পরও মালিকদের সঙ্গে চাল সংগ্রহের চুক্তি করেছিল। ভবিষ্যতে এটা হবে না।

তিনি আরও বলেন, গেল ঈদের আগে উপজেলায় চাল বিতরণের সময় পাথর পাওয়া গিয়েছিল। সেটি নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

অভিজিৎ ঘোষ/আরএআর