রংপুর মহানগরীর শাপলা চত্বর হাজীপাড়া এলাকা। এক সময় উন্নয়নের ছিটেফোঁটা না থাকলেও এই এলাকা ছিল অনেকটাই পরিপাটি। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে এখানকার পরিবেশ। এলাকার মূল সড়ক পিচঢালা, অলিগলির সব সড়ক কংক্রিটের ঢালাই করা। হয়েছে উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বাড়ি বাড়ি রয়েছে ডাস্টবিন। আগের চেয়ে বেড়েছে মানুষের বসবাস। সঙ্গে বেড়েছে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতাও। নগর উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় পুরো নগরীর যত্রতত্র ইচ্ছে মতো গায়ে গায়ে উঠছে ভবনের পর ভবন।

রংপুর মহানগরী ঘুরে দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি বিভাগীয় শহর। এই মহানগরের রাস্তাঘাটের কিছুটা উন্নয়ন হলেও হিসেব মিলবে না দৈর্ঘ্য-প্রস্থে। ঘোষণা ও কাগজপত্রে মহানগরীর প্রধান সড়কটি ৬৫ ফুট প্রশস্ত হলেও স্থানভেদে কোথাও কম আবার কোথাও বেশি। চোখে পড়বে রাস্তার ওপর বিদ্যুতের পোল, কোথাওবা রাস্তার মাঝেই। একই পোলে ঝুলছে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ইন্টারনেট ও ডিসের সংযোগ লাইন। কোথাও ড্রেনের চেয়ে রাস্তা উঁচু, আবার কোথাও খালের চেয়ে রাস্তা নিচু। রয়েছে ড্রেনের সঙ্গে সুয়ারেজের পাইপ। রংপুর বিভাগ প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পরও যেন এখনো পুরো মহানগর রয়েছে অগোছালো।

১০ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস রংপুর মহানগরীতে। অথচ কোথাও কোনো পরিকল্পনার ছাপ নেই। নগরীর সচেতন মহল বলছে, আবাসিক ভবন কোথায় হবে, বাণিজ্যিক ভবন কোথায় হবে- এ ধরনের কোনো নির্দেশনাও নেই। ফলে যত্রতত্র ইচ্ছে মতো চলছে নগরায়ণ। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমানহারে আশপাশের জেলা থেকে মানুষ আসছে রংপুরে। পাল্লা দিয়ে নগরজুড়ে বাড়ছে যানজট।

অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘরের পাশাপাশি বাণিজ্য প্রসারে হোটেল, মোটেল, মার্কেট, ছোট-বড় কলকারখানা, আবাসিক ভবন বা বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে শহরের সৌন্দর্য বাড়ছে না। বরং বাড়ছে ইট-বালু আর রড-সিমেন্টের জঞ্জাল। দিন দিন রংপুর মহানগর অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা নগরীতে পরিণত হচ্ছে।

এদিকে অগোছালো উন্নয়ন বা নগরায়ণের দায় নিতে চাইছে না রংপুর সিটি করপোরেশন। বরং অনুমোদনের আট বছরেও ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন না হওয়াকে দোষারোপ করা হচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বিভাগীয় জেলা রংপুরে পরিকল্পিত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নাগরিকরা। সঙ্গে অপরিকল্পিত উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে পৌরসভার জনবল কাঠামো দিয়ে নগরবাসীকে সেবা দেওয়া জনপ্রতিনিধিদের।

উন্নয়নে অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছে প্রাচীনতম জেলা রংপুর। এ কারণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি জিলা স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় রংপুরের উন্নয়নের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। এরই অংশ হিসেবে রংপুর বিভাগ, সিটি করপোরেশন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এছাড়া চার লেন মহাসড়ক, পীরগঞ্জে মেরিন একাডেমি, তারাগঞ্জে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, রংপুর বিভাগীয় সদর দপ্তর নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। এখনও অনেকগুলো উন্নয়নমূলক কাজ চলমান রয়েছে।

বর্তমানে পরিকল্পিত নগরায়ণে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে লালফিতায় বন্দি থাকা ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’। দীর্ঘ আট বছরেও এই প্রকল্পটি আলোর মুখ না দেখায় রংপুর মহানগরীকে ঘিরে কোনো মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। অথচ ২০১৪ সালের ৮ জুন সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন ভূঁইঞার সভাপতিত্বে প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় এগুলোতে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ করে স্বশাসিত সংস্থা গঠনের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামতের আলোকে টেকনিক্যাল কমিটি যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রস্তাবিত রংপুরসহ তিনটি উন্নয়ন (রংপুর, সিলেট ও বরিশাল) কর্তৃপক্ষের আইনের খসড়া আইন প্রণয়ন করে।

উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের জন্য সচিব কমিটিতে উত্থাপিত সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, স্বশাসিত এই তিন সংস্থা গঠন হলে জাতীয় স্বার্থে সিলেট, রংপুর ও বরিশাল এলাকার উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পিত উন্নয়ন সম্ভব হবে। তিন বিভাগীয় সদর এলাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন নানা সমস্যার সৃষ্টি করছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রকল্প বাস্তবায়ন, অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন, হোটেল-মোটেল এবং অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ এ ধরনের সমস্যার মূল কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তিনটি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন সম্পর্কিত আইনের খসড়ার জন্য জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে মতামত নেওয়া হয়েছে বলে সারসংক্ষেপে উল্লেখ রয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, রংপুর, সিলেট ও বরিশাল জেলা বিভাগে উন্নীত হওয়ার ফলে অনেক স্থানই আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট করার অনুকূল অবস্থা রয়েছে। এ তিন বিভাগীয় শহরে কর্তৃপক্ষ না থাকায় স্থানীয় পৌরসভায় বেসরকারি পর্যায়ে নির্মিত ভবনের নকশা অনুমোদনসহ অন্যান্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়। যদিও বহুতল ভবন বা নগরীর সৌন্দর্য রক্ষা করে নগর বিকাশে কোনো ধারণা ও কারিগরি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনবল নেই সিটি করপোরেশনের। যুক্তিসঙ্গতভাবে আধুনিক ও পরিকল্পিত নগরী হিসেবে উন্নয়ন ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বার্থে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা অপরিহার্য।

এদিকে মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন ও এর কোনো কার্যক্রমের অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ নগরবাসী। সরকারের উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে কাজের গুণগতমান নিশ্চিত করতে দ্রুত রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবি নাগরিক সমাজের।

নগরীর শাপলা চত্বর হাজীপাড়া এলাকার মোসলেমা বেগম বলেন, আমার বাড়ির ডানে-বামে ও পেছনে তিন-চারটি বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। কিন্তু কেউই নিয়ম মেনে জায়গা ছেড়ে ভবন নির্মাণ করেননি। গায়ে গায়ে ঘেঁষা এসব ভবনের কারণে একটু বৃষ্টি হলেই বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ে। সিটি করপোরেশন থেকে কেউ এসব দেখভাল করে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগরের সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, রংপুর বিভাগ ও রংপুর সিটি করপোরেশন হওয়ার দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও পরিকল্পিত নগরী গড়ার কোনো পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। মাস্টারপ্ল্যান ছাড়াই হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ।  

তিনি আরও বলেন, একটি আধুনিক নগরের প্রথম শর্ত হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন। রংপুর মহানগরকে উন্নত নাগরিক সুবিধা, তথ্য-প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া রংপুরকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কিন্তু কেন এটাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে  না, এটা ভাবার বিষয়।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সংগঠক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, দেশের অন্যতম অপরিকল্পিত নগরগুলোর একটি রংপুর। এই নগরকে পরিকল্পনার আওতায় আনতে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করার কথা ছিল। অথচ আট বছরেও আজ এটি বাস্তবায়ন হয়নি। যেভাবে রাস্তা নির্মাণে যানজট কমবে, জলাবদ্ধতা কমবে সেই উপায়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা করার দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু সেই মাস্টারপ্ল্যান নেই। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন, রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরিসহ রংপুরকে ঢেলে সাজানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক।

এদিকে দ্রুত ‌‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের তাগিদ দিয়ে এরই মধ্যে লিখিত মতামত মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে রংপুর সিটি করপোরেশন। 

এ ব্যাপারে মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আট বছর আগে মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন দিয়েছে। অথচ দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও এটি বাস্তবায়ন হয়নি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। রংপুর উন্নয়ন প্রকল্প এবং নগরীকে ঘিরে কোনো মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা ভেবেছিলাম গত সংসদ অধিবেশনে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়নের ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে, কিন্তু সেটা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, জনবল কাঠামো অনুমোদন হয়নি। বিলুপ্ত পৌরসভার জনবল কাঠামো দিয়ে সিটি করপোরেশন চলছে। মাস্টারপ্ল্যান হয়নি। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং নগরকে ঘিরে কোনো মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন মেয়র।

আরএআর