বাঁয়ে সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর, ডানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা বেগম

নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় খেলার মাঠের কিছু অংশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার (১৩ আগস্ট) সংবাদ সম্মেলন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদা বেগম। সেখানে দেওয়া ইউএনওর বক্তব্য ফেসবুকে পোস্ট করেন হুমায়ূন কবীর নামে স্থানীয় এক সাংবাদিক। এতেই ক্ষেপে যান ইউএনও মাহমুদা। এরপর ওই সাংবাদিককে কল দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি তাকে মামলায় জড়ানোর ‘হুমকি’ দিয়েছেন ওই ইউএনও।

শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ইউএনওর ব্যবহৃত মুঠোফোন থেকে কল করে এ ‘হুমকি’ দেন বলে জানা গেছে। হুমকি পাওয়া সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর দৈনিক সংবাদ ও ইংরেজি অবজারভারের কেন্দুয়া উপজেলা প্রতিনিধি। তিনি কেন্দুয়া প্রেসক্লাবের সদস্য। এ ঘটনায় জেলার সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। 

সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর জানান, শনিবার ভোরে উপজেলার বলাইশিমুল খেলার মাঠের জায়গায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য নির্মাণাধীন প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে ওইদিন বিকেলে ইউএনও উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে ইউএনওর ১১ মিনিট ২৮ সেকেন্ডের বক্তব্য হুমায়ূন কবীর ভিডিও আকারে ধারণ করেন। পরে তিনি সেই ভিডিও নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে পোস্ট করেন। এরপর সন্ধ্যায় ইউএনও তার কাছে ফোন করে জানতে চান, সংবাদ সম্মেলনে তার (ইউএনও) দেওয়া বক্তব্য কেন ফেসবুকে দেওয়া হয়েছে।

হুমায়ূন কবীর বলেন, ইউএনও মহোদয় রাগতস্বরে আমাকে বলেন, ‘আপনাকে কি ফেসবুকে ছাড়ার জন্য আমি বক্তব্য দিছি? আমি প্রেস ব্রিফিং যা দিছি, সেটা দিয়া নিউজ করবেন।’ তখন আমি বলি, আমি সাংবাদিক হিসেবে কি ফেসবুকে দিতে পারি না? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি বিরোধিতা করেন, তবে আমি আপনাকে আজকের মামলায় ঢোকাতে বাধ্য হব।’

হুমায়ূন কবীর আরও বলেন, একজন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ধরনের হুমকি কখনও কাম্য নয়। আমি এ ঘটনায় ইউএনওর প্রত্যাহার দাবি করছি।

কেন্দুয়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কাজল বলেন, সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও ফেসবুকে প্রচার করে হুমায়ূন কবীর কোনো অপরাধ করেছেন বলে আমি মনে করি না। কিন্তু এ নিয়ে ইউএনও একজন সাংবাদিককে ফোন করে মামলার হুমকি দিতে পারেন না। আমরা তার প্রতিবাদ জানাই। বিচার চাই।

এ বিষয়ে ইউএনও মাহমুদা বেগম জানান, সাংবাদিক হুমায়ূন প্রথম থেকেই এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছেন। নানা সময়ে এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এসব স্ট্যাটাসের কমেন্টে অশালীন কথাবার্তা লেখা হয়েছে। কোনো ব্যবস্থা নিইনি। আগেই তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা উচিত ছিল। সাংবাদিকদের  সঙ্গে নানা সময়ে নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয়। তিনি সেগুলোও ফেসবুকে প্রচার করে দেন।

এদিকে সাংবাদিকের সঙ্গে এ ধরনের কথাবার্তা বলা উচিত হয়নি জানিয়ে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, বিষয়টি শুনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করাসহ ইউএনওকে সতর্ক করা হয়েছে।

জানা গেছে, বলাইশিমুল গ্রামের ১ একর ৮৭ শতক সরকারি জায়গায় শত বছরের পুরোনো খেলার মাঠ রয়েছে। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২–এর আওতায় ওই মাঠের পাশে প্রশাসন ভূমি ও গৃহহীনদের জন্য ২৩টি ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু স্থানীয় ব্যক্তিরা শুরু থেকেই মাঠ রক্ষায় মানববন্ধন, মিছিল করে আসছিলেন। পাশাপাশি স্থানীয় হাবিবুর রহমান মণ্ডলসহ আটজন বাদী হয়ে গত ৩০ মে আদালতে একটি মামলা করেন। এরপর গত ২ জুন রাতের আঁধারে দুটি নির্মাণাধীন ঘরের গাঁথুনি ভেঙে দেয় দুর্বৃত্তরা। পরের দিন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী বাদী হয়ে ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। এরপর ওই স্থানে পুলিশ পাহারায় ঘর নির্মাণের কাজ চলছে।

সম্প্রতি ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার মো. শফিকুর রেজা বিশ্বাস, নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেখান থেকে ১১টি ঘরের নির্মাণকাজ বাতিল করেন। ১২টি নির্মাণাধীন ঘরের মধ্যে আবারও দুর্বৃত্তরা দুটি ঘরে আগুন দেয়। এ ঘটনায় পরদিন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেশকাতুল বাদী হয়ে ৬৩ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। পরে আগুন দেওয়ার ঘটনা নিয়ে ইউএনও প্রেস ব্রিফিং করেন।

প্রেস ব্রিফিংয়ে ইউএনও অভিযোগ করে বলেন, ‘বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বামদল সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করছে। আমরা প্রশাসন সর্বোচ্চ ধৈর্য ধরেছি। আর নয়। যত আইন, যা যা প্রয়োগ করা দরকার, তাই করব। দরকার হলে পুরো বলাইশিমুল ইউনিয়নের মানুষকে গ্রেপ্তার করব। ইউনিয়নের সবার বিরুদ্ধে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করা হবে।’

বলাইশিমুল মাঠ রক্ষা গণকমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আল আজাদ বলেন, ‘আমরা কেউ আশ্রয়ণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু এলাকায় অনেক সরকারি জমি থাকতেও ঐতিহ্যবাহী একটি মাঠ দখল করে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো যুক্তি নেই। সেজন্য শত বছরের মাঠটি রক্ষায় আমরা শুরু থেকেই আন্দোলন করে আসছি। এখন আন্দোলনকারীদের দমন করতে একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।’

খেলার মাঠে আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা 

এদিকে নেত্রকোণার কেন্দুয়ার বলাইশিমুল মৌজায় খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণকাজের ওপর তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রোববার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। আদেশ বাস্তবায়ন বিষয়ে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসককে ৬০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ওই খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ওই রিটটি দায়ের করে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায়।

রুলে ওই খেলার মাঠের শ্রেণি পরিবর্তন কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং ঐতিহাসিক বলাইশিমুল মাঠটি মাঠ হিসেবে সংরক্ষণ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। ভূমিসচিব, পরিবেশসচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, প্রকল্প পরিচালক (আশ্রয়ণ-২), নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

উবায়দুল হক/আরএইচ