বঙ্গোপসাগরে বৈরী আবহাওয়ায় প্রচণ্ড ঢেউয়ের কবলে পড়ে ট্রলারডুবির ঘটনায় পাঁচ জেলে নিখোঁজ হন। সাত দিন পেরিয়ে গেলেও তাদের এখনো কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এতে পরিবারগুলোয় চলছে মাতম। জীবিত অথবা মৃত— যেভাবেই হোক তাদের ফিরে পেতে চান পরিবারের সদস্যরা।

ঘটনা সূত্রে জানা যায়, গত ৯ আগস্ট বৈরী আবহাওয়ায় সাগরে প্রচণ্ড ঢেউয়ের কবলে পড়ে ডুবে যায় মাছ ধরার ট্রলার 'এফবি নিশান'। এতে সাত জেলে জীবিত উদ্ধার হলেও নিখোঁজ হন পাঁচজন। সাত দিন ধরে তাদের সন্ধান না পাওয়ায় পরিবারগুলো দিশেহারা। তাদের মাতমে পরিবেশ ভারী হয়ে আসে। প্রিয় স্বজনদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেটি এখনো জানেন না তারা। দিন যতই যাচ্ছে, নিখোঁজদের পরিবারে বাড়ছে শোক, হতাশা, অভাব।

নিখোঁজ জেলেরা হলেন হাতিয়া উপজেলার হরনী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বয়ারচর গ্রামের মোশাররফ হোসেনের ছেলে ইয়াসিন আরাফাত (৩৫), আব্বাস উদ্দিনের ছেলে আলকাস উদ্দিন (৩০), ইউনুস মাঝির ছেলে সোহেল উদ্দিন (২৫), নবীর উদ্দিনের ছেলে ইয়াকুব উদ্দিন (৩০) এবং হাতিয়া উপজেলার চানন্দী ইউনিয়নের শরীয়তপুর গ্রামের আমজাদ উদ্দিনের ছেলে আশরাফ উদ্দিন (৩৩)।

সরেজমিনে হাতিয়া উপজেলার হরনী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বয়ারচর গ্রামে দেখা গেছে, সাত দিন স্বামীর জন্য আহাজারি করে প্রায় বাকরুদ্ধ সিরাজ উদ্দিনের বাড়ির নিখোঁজ জেলে সোহেলের স্ত্রী জান্নাত বেগম।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামী কই? তারে আপনারা আইনা দেন। তিনি আমারে ফোন করে না কেন? দুই কন্যা সন্তান নিয়ে এখন কই যামু? তাদের খোঁজ জানি না কেন?

পাশের বাড়ির নিখোঁজ জেলে ইয়াছিন আরাফাতের মা তানজিনা বেগম বলেন, ছেলে আমারে বলসে, মা, আমি ওই বোটে যামু না। আমার ভয় লাগে। মালিক আমারে ধরে নিয়ে আসছে। আপনারা আমার ইয়াসিনকে আইনা দেন। আমার দুইটা নাতনি আর বউ নিয়ে এখন আমি কই যামু?

পাশের বাড়ির নিখোঁজ আলকাসের মা পাগলপ্রায়। তিনি আমার বাবারে আইনা দে বলে চিৎকার দিয়ে কান্না করেন এবং মূর্ছা যান। আলকাসের স্ত্রী জমিলা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার জামাই সাগরে গেছে। দুইটা বাচ্চা রেখে গেসে। আমাদের নিজের ভিটা পর্যন্ত নাই।

ছেলে ফেরার অপেক্ষায় থাকা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের বিলাপ থামছে না কোনো আশ্বাসেই। মিজামের দুই শিশু ছেলেও বাবার ফেরার অপেক্ষায়। জীবিত হোক বা মৃত, তাদের উদ্ধারে সরকারের সহায়তা চান স্বজনরা।

শুধু সোহেল, ইয়াছিন ও আলকাসের বাড়িতেই নয়, একই অবস্থা নিখোঁজ অপর জেলে পরিবারেও। সময়ের সঙ্গে বাড়ছে স্বজন হারানোর শঙ্কা। প্রবল ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে সাগরে যাওয়ার সাধ্য নেই, তাই মেঘনার তীরেই নিখোঁজদের ফেরার অপেক্ষায় অনেক স্বজন।

উদ্ধার হওয়া ট্রলারের মাঝি মো. শামীম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৯ আগস্ট এমবি নিশান নামের মাছ ধরার ট্রলারটি ঝড়ের কবলে পড়ে নিঝুম দ্বীপের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে গিয়ে পটুয়াখালী জেলাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে ডুবে যায়। তখন পাশে থাকা একটি জেলে ট্রলারের জেলেরা তাদের চারজনকে জীবিত উদ্ধার করে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুরে নিয়ে যান। গত দুই দিনে আরও আট জেলেকে জীবিত উদ্ধার করেছেন স্থানীয় জেলেরা।

এ নিয়ে উদ্ধার হওয়া জেলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২-তে। এখনো পাঁচ জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। নিখোঁজ জেলেদের সন্ধান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

নবীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বোরহান উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাতিয়া নদীবেষ্টিত এলাকা। এখানে নদীতে মাছ ধরে বেশির ভাগেরই সংসার চলে। কিন্তু এরা মারা গেলে লাশও পাওয়া যায় না। ফলে স্বজনদের কবর দেওয়ারও সুযোগ থাকে না। আবার কবর দেওয়া গেলেও নদীতে ভেঙে যায় তাদের কবর।

হরনী ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নাজমা আরিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলেরা নদীতে মাছ ধরে নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি সরকারি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন। তাই সরকারের উচিত এই অসহায় পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো।

হরণী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আখতার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রলারডুবির ঘটনায় আমার হরণী ইউনিয়নের ৯ জন জেলে নিখোঁজ ছিলেন। চারজনকে পাওয়া গেলেও পাঁচজনের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। পরিবারগুলো অসহায় হয়ে পড়েছে। স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে গেছে। আমাদের সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী তাদের সহযোগিতা করেছেন।

দুর্ঘটনার কবলে পড়া ট্রলারের মালিক হাতিয়ার জাহাজমারা আমতলী গ্রামের বাসিন্দা লুৎফুল্লাহিল মজিব নিশান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলেদের খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এতগুলো মানুষ নিখোঁজ, আমার কেমন লাগে, আমি বলে বোঝাতে পারব না। আমি নিখোঁজ জেলেদের পরিবারের পাশে আছি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিখোঁজ জেলেদের উদ্ধারে কোস্টগার্ডের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তাদের যদি জেলে কার্ড থাকে, তাহলে বিধিমোতাবেক সরকারি অনুদান প্রদান করা হবে।

এনএ