ফলের রাজা আমের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্ম ও বেড়ে ওঠা মোশাররফ হোসেনের (৩৩)। পারিবারিকভাবেই আম চাষাবাদ করেন। তবে আম পচনশীল ফল হওয়ায় চোখের সামনে বিপুল পরিমাণ অর্থের আম প্রতি বছর নষ্ট হতে দেখেন। ফলে আমের প্রতি নির্ভরতা কমিয়ে অন্য কোনো ফল চাষাবাদের চিন্তা আসে তার মাথায়। এমন চিন্তা থেকেই সৌদি আরবের খেজুর চাষের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দায়পুকুরিয়া ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের আলহাজ ইনসান আলীর ছেলে মোশাররফ হোসেনের। 

তিন বছর আগে ২০১৯ সালে গড়ে তোলেন সৌদি খেজুরের বাগান। প্রায় দুই বিঘা জমি ইজারা নিয়ে শুরু করলেও এখন তার খেজুর বাগানের পরিধি প্রায় ১০ বিঘা জমিতে। ১৩০০ গাছ লাগানোর মধ্য দিয়ে বাগান শুরু করা মোশাররফ হোসেনের খেজুর বাগানে এখন গাছের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। গত বছর মাত্র দেড় বছর বয়সী গাছে খেজুরের ফলন আসায় হতবাক স্থানীয়রা। মোশাররফ হোসেনের বাগানে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে কাঁচা-পাকা সৌদি খেজুর।
 
নিজেদেরই বেশ কিছু জমি আছে। কিন্তু পরিবারের লোকজনের সমর্থন না থাকায় অন্যের জমি ইজারা নিতে হয় মোশাররফ হোসেনকে। ইউটিউব দেখে ও প্রবাসী বন্ধুদের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন সৌদি খেজুরের বাগান। তার বাগানে এখন ঝুলছে বিখ্যাত আজোয়া, মরিয়ম, দাবাস, বারিহী, চেগিসহ অন্তত ১০ জাতের খেজুর। প্রতিনিয়ত মোশাররফ হোসেনের খেজুর বাগান দেখতে আসছে আশপাশের তরুণ ও কৃষি উদ্যোক্তারা। 

স্থানীয়রা আমের রাজধানীতে সৌদি খেজুরের বাগান করা নিয়ে প্রথম দিকে নানা উপহাস করলেও গত বছর থেকে গাছে ফলন দেখে ধারণা পাল্টে গেছে তাদের। অনেকেই মোশাররফ হোসেনের কাছ থেকে চারা নিয়ে সৌদি খেজুর চাষাবাদ শুরু করেছেন। প্রথম দিকে চারা উৎপাদন করতে গিয়ে নানা রকম ভোগান্তি ও লোকসানের মধ্যে পড়তে হয় মোশাররফ হোসেনকে। এমনকি সরাসরি খেজুর বাগান দেখতে ছুটে গেছেন ময়মনসিংহ। 

মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি বছর চোখের সামনে হাজার হাজার মণ আম নষ্ট হয়। ফলে ভিন্ন কোনো ফল, যা সহজে নষ্ট হয় না এমন ফল চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। চ্যানেল আইতে শাইখ সিরাজের করা ময়মনসিংহের একটি খেজুর বাগানের প্রতিবেদন দেখে উদ্বুদ্ধ হই। জানতে পারি, খেজুর পচনশীল নয়। গাছ থেকে পাড়ার পর দীর্ঘদিন শুকিয়ে রাখা যায় ও সহজে পচে না। প্রতিবেদনে দেখানো সেই বাগানটি সরেজমিনে দেখি আসি ২০১৬ সালে। এরপর ইউটিউব ও প্রবাসী বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে শুরু করি সৌদি খেজুরের চাষাবাদ। নিজের জায়গা না থাকায় অন্যের জমি ইজারা নিয়ে চাষাবাদ শুরু করতে হয়। কারণ পরিবারের বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি কেউই সৌদি খেজুর চাষের পক্ষে সমর্থন দেননি। 

তিনি আরও বলেন, সৌদি খেজুর চাষের শুরুর দিকে লোকজন নানা রকম হাসি-ঠাট্টা, উপহাস করেছিল। সবাই বলতে থাকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের জেলা, এই মাটিতে আম ছাড়া অন্য কোনো ফল, বিশেষ করে মরুভূমির খেজুর চাষ করা অসম্ভব। প্রথম দিকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে ইউটিউব দেখে ও প্রবাসে থাকা বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে চাষ করতে থাকি। চলতি বছর প্রায় সাড়ে তিন শ গাছে খেজুর এসেছে। গত বছর যা প্রায় তিন শ গাছে ছিল। আগামী বছর আশা করি আরও বেশি গাছে খেজুর আসবে। 

কৃষি উদ্যোক্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রথম দুই বছরে আমি কোনো খেজুর বিক্রি করিনি। চারা কিনতে আসা ও স্থানীয় লোকজন যারা বাগান দেখতে আসছেন, তাদের সবাইকে খেজুরের স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ দিয়েছি। সবাই গাছ থেকে পেড়ে সৌদি খেজুর খেতে পেরে আনন্দ প্রকাশ করছে। সবাই অবাক হচ্ছে- এই খেজুর আমাদের এই মাটিতেই হয়েছে। অথচ স্বাদ হুবহু সৌদি খেজুরের মতোই। শুধুমাত্র খেজুর ও গাছের চারা নয়, আগামীতে খেজুর গাছের পাতা থেকে শীতল পাটি তৈরি করে পরিকল্পনা রয়েছে। 

স্থানীয় বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম জানান, প্রথমদিকে যখন এমন একটি জায়গায় খেজুর বাগান করছিল, তখন আমরাই নানারকম কথা বলেছি। এই জমিতে কীভাবে খেজুর চাষ হয় তা আমাদের ভাবনাতেও আসেনি। দুই বছর পর যখন তার বাগানে এ রকম থোকায় থোকায় ঝুলতে থাকা খেজুর দেখলাম, তখন অবাক হয়েছি। খেয়ে দেখলাম পুরোপুরি সৌদি আরবের খেজুরের মতোই স্বাদ। 

মোশারফ হোসেনের খেজুর বাগানের পাশের বাড়ি মোহাম্মদ বিসু আলীর। তিনি বলেন, গ্রামের লোকজন মোশারফ হোসেনকে নিয়ে এখন গর্বিত। কারণ তার এই বাগানের খবর পৌঁছে গেছে সারা দেশে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তার খেজুরের চারা নিতে আসছেন কৃষি উদ্যোক্তারা। খেজুর বাগানে এমন খেজুর দেখে আমরা সবাই হতবাক। মোশারফ হোসেনকে দেখে আশপাশে অনেক তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা খেজুর চাষাবাদে আগ্রহী হয়েছেন। 

খেজুর বাগানের পাহারাদার বৃদ্ধ দাউদ আলী (৭০) জানান, খেজুর বাগানটি এখন সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক দর্শনার্থী ও কৃষি উদ্যোক্তা এসে বাগান পরিদর্শন করছেন। তাদের সকলের জন্য বরাদ্দ রয়েছে অন্তত একটি করে খেজুর। সকলেই গাছ থেকে পেড়ে সৌদি খেজুর খেয়ে দেখছেন। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) রাজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সৌদি খেজুর চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাষাবাদ করা সম্ভব তা প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি একটু কষ্টকর। চাষের পূর্বে ভালোমতো জমি তৈরি করতে হবে। মাটিকে প্রথমে কিছুটা বেলে মাটিতে রূপান্তর করতে হবে। প্রয়োজনে কিছু বালু মেশানো যেতে পারে। মাটিতে প্রচুর পরিমাণে জৈব সার থাকতে হবে। পানি যেন জমিতে আটকে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়াও বৃষ্টির সময় ফল পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ইউটিউব দেখে অনেকেই খেজুর চাষাবাদ শুরু করেন। ইউটিউবে এমন অনেক তথ্য থাকে, যা দেখে চাষ করতে গেলে বিপদে পড়তে হয়। তাই চাষ শুরু করার আগেই পুরোপুরি সৌদি খেজুর চাষ সম্পর্কে জেনে নেওয়া উচিত। চাষাবাদ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জেনে চাষাবাদ করলে তিন বছরের মধ্যে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। 

আরএআর