ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৬২ সালে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে ছোট ছোট রেলপথ সেকশন চালু করতে থাকে। প্রথম দিকে শুধু অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করা হয়। এরই অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রম শেষ হয় ১৮৮৫ সালে। আর ১৮৯৪ সালে এ রেলপথ নিয়ে আসা হয় জামালপুর পর্যন্ত। 

এরপর ১৮৯৯ সালে এই রেলপথ সরিষাবাড়ী উপজেলার জগন্নাথগঞ্জ পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। ক্রমবর্ধমান যাত্রীর চাপ সামাল দিতে ১৯১২ সালে জামালপুরকে জংশন করে একটি লাইন নিয়ে যাওয়া হয় বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত। ঠিক সে সময়ই নির্মিত হয় বাহাদুরাবাদ ঘাট রেলওয়ে স্টেশন।

সে সময় কলকাতা, পশ্চিমবাংলা এবং উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য বাহাদুরাবাদ ঘাট বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার রেলপথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল বাহাদুরাবাদ ঘাট।

জামালপুর রেলওয়ে বিভাগ জানায়, জামালপুর রেলওয়ে সেকশনের আওতায় ময়মনসিংহের বিদ্যাগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে জামালপুর জংশন হয়ে তারাকান্দি, সেখান থেকে যমুনা সেতু পূর্ব এবং জামালপুর-বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত রেলপথ  ১০২ কিলোমিটার। এই রেলপথে মোট ১৮০টি রেলক্রসিং থাকলেও অনুমোদিত রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ১২৭টি। অনুমোদিত ১২৭টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে গেটম্যান আছেন মাত্র ৪২ জন। এই রুটে ১০টি আন্তঃনগর ট্রেনে নিয়মিত হাজারো যাত্রী চলাচল করেন।

অনুমোদনহীন ৫৩টি লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান তো দূরের কথা, গেটও নেই। কোনো কোনো স্থানে ছোট একটি সাইনবোর্ড ঝুঁলিয়ে দায়িত্ব সেরেছেন রেল কর্তৃপক্ষ। আবার কোনো কোনো স্থানে গেট ব্যারিয়ার থাকলেও ট্রেন যাতায়াতের সময় তা নামানোর লোক নেই। অরক্ষিত এসব ক্রসিং দিয়ে প্রতিনিয়ত পারাপার হচ্ছে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, পণ্যবাহী অসংখ্য যানবাহন ও পথচারী।

ঝুঁকিপূর্ণ এসব ক্রসিং অতিক্রম করতে গিয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। ২০১৪ সালে জামালপুরের মেলান্দহের নয়ানগরে এমনই এক ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে ইজিবাইকের সংঘর্ষে নিহত হয় ৫ জন। ২০১৭ সালে জামালপুর পৌর এলাকার চন্দ্রা ঘুন্টিতে ট্রেনের নিচে চাপা পড়ে ৬ ইজিবাইক যাত্রীর মৃত্যু হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের মে মাসে জেলার সরিষাবাড়িতে এমনই এক লেভেল ক্রসিংয়ে দুইজনের মৃত্যু হয়। এছাড়াও প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট-বড় নানা দুর্ঘটনা।

অরক্ষিত এসব লেভেল ক্রসিংয়ে একাধিক দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন মানুষের প্রাণ গেলেও গেট ব্যারিয়ার স্থাপন এবং গেটম্যান নিয়োগে উদ্যোগ নেয়নি রেল কর্তৃপক্ষ।

জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার বাসিন্দা আকবর আলী বলেন, আমাদের সাতপোয়া জামতলা মোড় এলাকার লেভেল ক্রসিংটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কিছু দিন আগেও সেখানে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। তবুও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আলী হাসান বলেন, জামালপুরের রেলওয়ে পথটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পথ। এই রেল পথটিকে গুরুত্ব সহকারে গোছানো প্রয়োজন। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। আমরা কেউই দুর্ঘটনা দেখতে চাই না।

জেলার মেলান্দহ উপজেলার বাসিন্দা বিজয় খান বলেন, প্রতিনিয়ত এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। তবুও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। কর্তৃপক্ষ চাইলে ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংয়ে জনবল নিয়োগ করে এসব দুর্ঘটনা রোধ করতে পারে। শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংয়ে জনবল নিয়োগ হচ্ছে না।

জামালপুরের মানবাধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যার চলে যায়, সে বোঝে বিচ্ছেদের কী যন্ত্রণা। আর কোনো মায়ের বুক খালি হওয়ার আগে জামালপুরের প্রতিটি লেভেল ক্রসিংয়ে জনবল নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি।

এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি জামালপুর রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজাউল হক।
তবে জামালপুর রেল স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার শেখ উজ্জল মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনগণ সচেতন হলে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। যে স্থানের লেভেল ক্রসিংয়ে দায়িত্বরত কেউ নেই, সেখানে জনগণের একটু সাবধান হয়ে চলাচল করা উচিত।

এসপি