উত্তরের জেলা দিনাজপুরকে বলা হয়ে থাকে শস্যভান্ডার। এই জেলায় যে পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়, তা জেলার চাহিদা মিটিয়েও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর জন্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে। প্রতিবছর খাদ্যশস্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ বাড়ছে, যদিও কমছে আবাদি জমির পরিমাণ।

কৃষকরা বলছেন, ফসলের ন্যায্যমূল্য ও সরকারি সহযোগিতা অনেকাংশেই পৌঁছাচ্ছে না তাদের দোরগোড়ায়। অথচ কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বাজারে বাড়ছে প্রতিনিয়তই, এতে লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা।

চালকলমালিক নেতাদের দাবি, দেশে শ্রমের দাম বেড়েছে, বেড়েছে ক্রয়ক্ষমতা। দাম বাড়লে লাভবান হবেন কৃষকরা। তবে চেম্বার নেতার দাবি, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বাড়েনি উৎপাদন।

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে প্রয়োজন সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণব্যবস্থা জোরদার করা। একই সঙ্গে শস্যের বহুমুখীকরণেরও দাবি তাদের। আর আবাদি জমি কমার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনার অভাব বলে মত তাদের।

দিনাজপুর জেলা কৃষি অফিসের তথ্যানুযায়ী, জেলায় বর্তমানে আবাদি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর। আর ফলের বাগান রয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৩৯ হেক্টর। এ বছর আবাদি জমি থেকে বিভিন্ন জাতের ধান উৎপাদন হয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৮ মে. টন আর গম উৎপাদন হয়েছে ২১ হাজার ৮০ মে টন। এ সময় ফল উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৪১০ মে. টন।

জমিতে কীটনাশক দিচ্ছেন এক কৃষক

হিসাবমতে, স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে যেখানে খাদ্য উদ্বৃত্ত ছিল ৭ লাখ ১৩ হাজার ২২৯ মে. টন, সেখানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে খাদ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ ৮ লাখ ১৯ হাজার ২৮৮ মে. টন। অথচ ২০০৭-০৮ অর্থবছরে জনসংখ্যা ছিল ২৮ লাখ ৮৩ হাজার ২০৭ আর খাদ্য চাহিদা ছিল ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৩৫৫ মে. টন। আর এক যুগ পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭৯৩ জন আর খাদ্য চাহিদা হয়েছে ৫ লাখ ৬২ হাজার ৮৪৭ মে. টন। বর্তমানে স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে খাদ্যশস্য ও ফলসহ প্রায় ১০ লাখ মে. টন দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হয়। এ ছাড়া গত ১০ বছরে জেলার মোট আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ।

সরেজমিনে দিনাজপুরের সদর উপজেলার উলিপুর এলাকার মাঠে দেখা যায় বেশ কয়েকজন কৃষকের ব্যস্ততা। ভালো ফলন আর ন্যায্যমূল্যের আশায় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চলছে তাদের কর্মযজ্ঞ। কেউ ধান ঢলায়, কেউবা বীজ বপণ, আবার কেউ আলুর জমি পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।

জমিতে জৈব সার দিচ্ছেন এক কৃষক

কথা হয় স্থানীয় কৃষক সাদেকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, একফসলি ধানের জমিতে এখন তিন ফসল হয়েছে। আমি আউশ ধান চাষ করেছিলাম দুই বিঘায়। তবে উৎপাদিত শস্য বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পাইনি। তাই সরকারের কাছে দাবি, আমাদের কৃষিপণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণ সহজলভ্য করার পাশাপাশি বিনামূল্যে সার, বীজসহ কৃষিপণ্যের সহজলভ্যতা প্রয়োজন। শুধু সাদেকুল ইসলামই নন, স্থানীয় সব কৃষকের অভিযোগ একই। তাদের দাবি, সরকারি সহযোগিতা যেন ঠিকমতো পাওয়া যায়।

পুলহাট এলাকার সিনজেনটা পরিবেশক মোস্তাক রুবেল বলেন, কৃষকের ফসলকে পোকামাকড় ও রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখতে কৃষককে সরকারি ব্যবস্থায় হাতেকলমে স্প্রে করার প্রশিক্ষণ প্রদান করা প্রয়োজন। পোকা নিধন ও রোগবালাইমুক্ত ফসলের উৎপাদনও বাড়বে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

বাংলাদেশ কৃষক সমিতি দিনাজপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক বদিউজ্জামান বাদল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ধান উৎপাদন মৌসুম শেষ না হওয়ার আগেই চালের দাম বেড়েছে। উৎপাদিত কৃষিপণ্য দেশের সর্বত্র সরবরাহ ও বাজারজাত হলেও দিনাজপুরের মানুষ দরিদ্র। সরকারের সহযোগিতা ও বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ তাদের উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণের জোর দাবি করেন।

আলুখেত পরিচর্যা করছেন কৃষকরা

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ তৌহিদুল ইকবাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রতিবছরই এই জেলায় কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। বাড়ছে জনসংখ্যা। তবে ফসলের উৎপাদন বাড়ায় জেলায় শস্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ বেড়েছে, যদিও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খাদ্যচাহিদা।

জেলার কৃষি কর্মকর্তার মতে, দিনাজপুর জেলা কৃষির চারণভূমি। শস্যের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে বিভিন্ন ফলফলাদিও। খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক সম্ভার ও সরবরাহের এই ধারা অব্যাহত রাখার আশাবাদ তার।

বাংলাদেশ মেজর ও অটো মেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি ও বিরল ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন, কৃষকের উৎপাদন বাড়লেও পাল্লা দিয়েই বাড়ছে খাদ্যশস্যের দাম। বর্তমানে বাজার অস্থির চাল নিয়ে। যদিও এই চাল উৎপাদনের জন্য ধানের মূল্যকেই দায়ী করছেন তিনি।

গাছ থেকে শিম সংগ্রহ করছেন চাষি

তিনি আরও বলেন, জেলায় চালকল রয়েছে ২ হাজার ১২২টি। এখানে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। সারাদেশেই গত কয়েক বছরে শ্রমের দাম বেড়েছে, বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। আর পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। দাম বাড়লে লাভবান হবেন কৃষকরা। ফলে পণ্যের দাম বাড়াকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা দরকার।

দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সুজা-উর রৌফ চৌধুরী বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে উৎপাদন তেমন বাড়েনি। ওই জায়গাটাতে যদি আরও উন্নয়ন করতে পারি, তাহলে খাদ্যের উৎপাদন বাড়বে। নিয়ন্ত্রণে থাকবে দাম। জেলা থেকে উদ্বৃত্ত ধান, গম, ভুট্টাসহ বেশ কিছু পণ্য আমরা অন্য জেলায় রপ্তানি করে আসছি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য অধ্যাপক হাবিবুল ইসলাম বাবুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ধানের বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিকল্প উপায় থাকলে কৃষকরা কৃষিতে জড়িত থাকতেন না। ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে প্রয়োজন সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণব্যবস্থা জোরদার করা, শিল্প গড়ে তোলা। শস্যের বহুমুখী করা। তাহলে কৃষকদের পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন হতো।

খেত থেকে আলু তুলছেন কিষানিরা

তিনি আরও বলেন, কৃষিজমি কমে যাওয়ার জন্য সরকারের পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। কোনো স্থাপনা গড়ে তোলার সময় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লক্ষ করা উচিত, যাতে কৃষিজমির ক্ষতি না হয়। সরকারি অনেক খাসজমি আছে, যেগুলো কাজে লাগানো যেতে পারে।

দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি, কৃষি অনুষদ) অধ্যাপক এ টি এম শফিকুল ইসলাম বলেন, দিনাজপুর জেলা একটি নিবিড় শস্য উৎপাদনের এলাকা। এখানে ফলের উৎপাদন বাড়ছে। একফসলি জমি থেকে দক্ষ কৃষকরা তিনটি ফসল উৎপাদন করছেন। ফলে সার্বিক উৎপাদন বাড়ছে। এই উদ্বৃত্ত খাদ্য জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায় রপ্তানি হচ্ছে।

তিনি বলেন, এই এলাকায় এমন কিছু ফসল বেশি পরিমাণে উৎপাদন হওয়ায় নষ্ট হচ্ছে। এ জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের সুপার শপের মতো সংরক্ষণ করা জরুরি। এতে অন্য সময়ে সেই ফসলগুলো ব্যবহার করা যেত।

কৃষিজমি কমে যাওয়ার বিষয়ে এই অধ্যাপক বলেন, জনসংখ্যা বাড়ার কারণে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। শহরের পরিধি বাড়ছে। আমাদের গ্রামগুলো শহরায়ণ হচ্ছে। এতে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। আমাদের ভাগ্য ভালো যে কৃষিজমির পরিমাণ কমলেও কৃষি উৎপাদন বাড়ছে।

এনএ