ধারণক্ষমতার বেশি ওজন হওয়ায় হুপার ভেঙে টাঙ্গাইলের গোপালপুরে রাইস মিলে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে ওঠে এসেছে।

সেদিন রাতে কী ঘটেছিল জানতে চাইলে শ্রমিকরা জানান, মিলের যে হুপারটি ভেঙে পড়েছে, সেটি তার আগের দিন নির্মাণ করা হয়েছে। হুপারটির ধারণক্ষমতা কতটুকু ছিল, সেটা না জেনেই কাজ শুরু করা হয়েছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই হুপারে বেশি ওজনের চাল হওয়ায় সেটি ধসে পড়ে শ্রমিকদের ওপর। ফলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাদের। ওই রাইস মিলটিতে ধান ও চাল মিলিয়ে দুটি সেকশনে অর্ধশত শ্রমিক কাজ করেন।

শ্রমিক আল আমিন বলেন, রাইস মিলে আগের দুটি হুপার ছিল। কর্তৃপক্ষ আরও একটি হুপার নির্মাণ করেন। সেটি রোববার উদ্বোধন করা হয়। নতুন হুপারটিতে ২৫০ বস্তা চাল ছিল। বেশি ওজন হওয়ায় সেটি ভেঙে পড়েছে। সেখানে নাজমুল ও মজনু নামে দুই ভাই শ্রমিকের কাজ করতেন। কিন্তু ঘটনার সময় মজনু মিলের বাইরে ছিল বলে সে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক বলেন, রাতে ওই তিন শ্রমিক তাদের কাজ আগে শেষ করতে গিয়েছিল। এ সময় ঘরের ভেতর বিদ্যুতের ঝলকানি দেখে দৌড়ে গিয়ে মেইন সুইচ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ধারণা করা হয়েছিল, হয়ত আগুন লেগেছে। পরে ঘরে গিয়ে দেখি হুপার ভেঙে শ্রমিকদের ওপর পড়ে আছে। পরে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয়রা তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে।

একতা এগ্রোফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড রাইস মিলের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. উজ্জ্বল বলেন, এটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। নিয়ম মেনেই হুপারটি নির্মাণ কাজ করা হয়েছে। একটু সমস্যা তো হতেই পারে। শ্রমিকদের ভুলের কারণেও এটা হতে পারে। মৃতদের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হবে।

গোপালপুর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ইনচার্জ নুরুল ইসলাম বলেন, একতা রাইস মিলের হুপারটির ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ওজনের চাল দেওয়ার কারণে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। হুপারটি ঝালাই কাজ সঠিকভাবে করা হয়নি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই চালু করা হয়েছিল।

টাঙ্গাইলের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক (সেফটি) মো. ফারুক হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাইস মিলটিতে সেফটির বিষয়টি ঘাটতি ছিল। হুপারটির নির্মাণ কাজের ত্রুটি ছিল। সেটি যথেষ্ট শক্ত করে নির্মাণ করা হয়নি। হুপারটির বেশি ওজন বহনের ক্ষমতা ছিল না। এরপরও আরও যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে।

গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটির সদস্য মো. পারভেজ মল্লিক বলেন, এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে আমিও একজন সদস্য। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে কমিটির সদস্যরা একতা রাইস মিলটি পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রতিবেদন জমা দেবেন।

এদিকে রাইস মিলে তিন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা দায় নিচ্ছে না মিল কর্তৃপক্ষ। তবে তারা মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে মালিক পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ পেতে মৃতের স্বজনদের অপেক্ষা করতে হবে সপ্তাহখানেক।

এর আগে ৪ সেপ্টেম্বর রাতে গোপালপুর পৌরসভার ডুবাইলে অবস্থিত একতা এগ্রোফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের একটি রাইস মিলে নতুন নির্মিত হুপার ধসে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। 

মৃত শ্রমিকরা হলেন- কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের বাসিন্দা বাচ্চু মিয়ার ছেলে আরিফ (২০), একই জেলার গারুহাড়া গ্রামের করিম মোল্লার ছেলে নুরুল ইসলাম (৩৫) ও নুর মোহাম্মদের ছেলে নাঈমুল ইসলাম (৩৩)।

এ ঘটনায় শ্রমিকদের স্বজনদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না থাকায় থানায় একটি অপমৃত্যুর  মামলা করা হয়েছে। নিহত শ্রমিকদের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে রাতে তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। পরে সোমবার রাতেই একটি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সযোগে তাদের মরদেহ নেওয়া হয় কুড়িগ্রামে।

এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল হোসেনকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পারভেজ মল্লিক, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হোসেন, গণপূর্ত বিভাগ, কলকারখানা পরিদর্শন কর্মকর্তা ও ফায়ার সার্ভিসের একজন করে প্রতিনিধি।

সরেজমিনে একতা এগ্রোফুড প্রোডাক্টসে দেখা গেছে, যে ঘরটিতে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটি তালা দিয়ে রেখেছে মিল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া মিলে প্রবেশাধিকারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। সাংবাদিকদেরও ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে সেখানে মালিক পক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত রাইস মিলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। 

অভিজিৎ ঘোষ/এসপি