রাজবাড়ী জেলার একমাত্র মর্গে নেই কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া। মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ কাটা-ছেঁড়া করা হয় আদিকালের হাতুড়ি-বাটাল আর ছুরি-চাকু, প্লায়ার্স দিয়ে। সনাতন এই কায়দায় একটি মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করতে সময় লাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেক ক্ষেত্রে ময়নাতদন্তের পর প্রতিবেদনের মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এমনকি দীর্ঘ দিন ধরে ডোম না থাকায় পরিচ্ছন্নতা কর্মী দিয়েই কাটা-ছেঁড়া করা হচ্ছে মরদেহ। 

জানা গেছে, রাজবাড়ী জেলার একমাত্র মর্গটি রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে শহরের ড্রাই আইস ফ্যাক্টরি এলাকায় অবস্থিত। জেলার পাঁচ উপজেলার কোনো না কোনো এলাকা থেকে প্রতিদিনই মর্গে এক বা একাধিক লাশ আসে ময়নাতদন্তের জন্য। এরপরই মূলত শুরু হয় বিড়ম্বনা। 

সদর হাসপাতালের অধীনে এ মর্গে আধুনিকতার ছিটেফোটাও নেই। ফ্যান, বাতি কিংবা ফ্রিজিং ব্যবস্থার পাশাপাশি লাশ কাটাছেঁড়া করার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। মান্ধাতার আমলের ভোঁতা ছুরি-চাকু দিয়েই চলছে ময়নাতদন্তের কাজ। ময়নাতদন্ত শেষে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের দোতলার ছোট্ট একটি কক্ষে ভিসেরা (নমুনা) রাখা হয়। নমুনা পরীক্ষাগারে দ্রুত পাঠানোর কথা থাকলেও তা সঠিকভাবে হয় না। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেতে অপেক্ষা করতে হয় দিনের পর দিন।

সরেজমিনে দেখা যায়, মর্গে আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। নেই ভেন্টিলেশন ও পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা।  চিকিৎসকদের বসার জন্য নেই কোনো আলাদা কক্ষ। পানির পাম্প চুরির পর আর তা কেনা হয়নি। এ কারণে নেই পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা। হাতুড়ি-বাটাল ছুরি-চাকু দিয়েই চলছে ময়নাতদন্তের কাজ। যেখানে একটি জেলা শহরে সর্বনিম্ন ২-৩ জন ডোম থাকার কথা, সেখানে ডোমের পদটি রয়েছে শূন্য। ফলে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দিয়ে মরদেহ কাটা হয়। তবে মর্গে লাশ সংরক্ষণের জন্য একটি ফ্রিজ আছে, কিন্তু নেই কোনো নৈশ প্রহরী। ফলে নানা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছে মৃতদের ময়নাতদন্ত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষজ্ঞ ও উপযুক্ত যন্ত্রপাতি সংকটের কারণে অনেক আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে জনমনে সন্দেহ, উদ্বেগ ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এমনকি অনেক নির্মম হত্যাকাণ্ডের ময়নাতদন্তে পাওয়া ভুল প্রতিবেদনের কারণে তা আত্মহত্যা হিসেবে মেনে নিতে হয় পুলিশ, আদালত ও স্বজনদের। তারা আরও বলেন, রাজবাড়ীতে মরদেহের নমুনা সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত হওয়া দরকার।

জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট উজির আলী শেখ বলেন, ‘আমাদের রাজবাড়ীতে মর্গে যে ভিসেরা আলামত রাখা হয়, সেগুলোর অবস্থা আরও উন্নত করা দরকার। আলামত তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষাগারে পাঠানো দরকার। মর্গ আধুনিক না হলে, কম-বেশি ভুল থেকেই যাবে। মর্গে কাটা-ছেঁড়ার আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকতে হবে। পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডোম থাকতে হবে। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাজের প্রতি মনোযোগ থাকা দরকার।

রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার এম এম শাকিলুজ্জামান বলেন, মামলার তদন্তে ময়নাতদন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও রাজবাড়ীতে তা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এ কারণে বিঘ্নিত হয় তদন্ত। তাছাড়া রাজবাড়ী মর্গে ডোমের পদ শূন্য। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও এটাই বাস্তবতা। একজন ক্লিনারকে দিয়ে ওইসব কাজ করানো হচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভুল রিপোর্ট আসে।

রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. ইব্রাহিম টিটোন বলেন, রাজবাড়ীর যে মর্গ রয়েছে, তা হাসপাতাল থেকে প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল ক্যাম্পাসে ২৫০ শয্যার নির্মাণকাজ শেষ হলে, সেখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত মর্গ করা হবে।

মীর সামসুজ্জামান/এসপি