শিল্প ও বাণিজ্য নগরী হিসেবে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ। দেশের জিডিপিতে এই জেলার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তবে জেলার শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতি হলেও বাণিজ্য সম্প্রসারণে যারা অক্লান্ত শ্রম দিয়ে পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসা করেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে। প্রতিনিয়ত এখানে মার্কেটের সংখ্যা বাড়লেও অগ্নিনির্বাপণ বিধিমালা মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ মার্কেটে নেই কোনো অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। 

এসব মার্কেটে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে নিমতলী কিংবা চকবাজারের চুরিহাট্টার চেয়েও বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে বলে ধারণা ব্যবসায়ীদের। মার্কেটের মালিকপক্ষকে বার বার বলেও কোনো সমাধান না হওয়ায় জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়েই চলছে বেচাকেনা।

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন ঢাকা পোস্টকে জানান, কী পরিমাণ মার্কেট অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে তার তালিকা প্রস্তুতসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরির কার্যক্রম চলছে। এই বছর আমরা এখনো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রস্তুত করিনি। তবে সর্বশেষ প্রতিবেদন (২০২১-২০২২) অনুযায়ী জেলায় মোট অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের সংখ্যা ৮৪টি। আমরা এ বিষয় নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি এই মাসের মধ্যেই নতুন প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে সক্ষম হবো।

এদিকে সরেজমিনে যে চিত্র দেখা গেছে তা উদ্বেগের। আর এই উদ্বেগকে মেনে নিয়ে শুধুমাত্র রিভার ভিউ কমপ্লেক্সেই ব্যবসা করছেন নারায়ণগঞ্জের পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ী। নগরীর বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে সুপরিচিত টানবাজারের রিভার ভিউ মার্কেটের এমন হেয়ালিপনা ও গাফিলতি মেনে নিয়ে ঝুঁকিতে বেচাকেনা করছেন পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। পর পর লাগোয়া পাঁচটি মার্কেট একত্রে হয়ে নামকরণ হয়েছে দ্য রিভার ভিউ কমপ্লেক্স। শহরের প্রধান বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট ও রেলওয়ে স্টেশন একেবারেই কাছে হওয়ায় মার্কেটগুলো বেশ জমজমাট থাকে। এখান থেকেই ঢাক, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অন্তত ৩০ জেলার খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের প্রয়োজনীয় তৈরি পোশাক কিনে নিয়ে যান। 

পাঁচ মার্কেটের প্রত্যেকটি ঘুরে দেখা গেছে, কোনোটিতে একেবারেই অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। কোনোটাতে থাকলেও মেয়াদ ফুরিয়েছে বছর চারেক আগেই। 

জোটভুক্ত ওই পাঁচ মার্কেটের হাবিব কমপ্লেক্সে ঘুরে দেখা গেছে, এর নিচ তলা ও দ্বিতীয় তলার মোট ১৬৮ দোকানের কোথাও নেই কোনো  য়ার এক্সটিংগুইশার। শুধুমাত্র ওই মার্কেটের জেনারেটর ঘরে একটি কার্বন ডাই অক্সাইডের বোতল থাকলেও নেই প্রস্তুতকারী কিংবা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের স্টিকার, নেই উৎপাদন কিংবা মেয়াদের স্টিকারও। 

এ বিষয়ে মার্কেট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে দেখা যায়, মার্কেটের অফিস কক্ষের সামনে লোহার রড দিয়ে খাঁচা বানিয়ে সেই খাঁচায় তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে মাত্র চারটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার। তবে এর একটিরও মেয়াদ নেই। সবকটির মেয়াদ শেষে হয়েছে এক থেকে চার বছর আগেই। এমন চিত্র শুধু রিভার ভিউ কমপ্লেক্সেরই নয়, জেলার বেশিরভাগ মার্কেটেই একই অবস্থার দেখা গেছে। 

জেলা ফায়ার সার্ভিসের সূত্র মতে, অগ্নিনির্বাপণ বিধি মেনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু নির্দেশনা থাকলেও নেই বাস্তবায়ন। ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্যিক ওইসব ভবনগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ বিধিমালা অনুযায়ী ফায়ার এক্সিট, ফায়ার অ্যালার্ম, স্মোক ডিটেক্টরের (ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র), সেফটি ট্যাংক নেই। এছাড়া নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনায় কনটিনজেন্সি প্ল্যান রাখা জরুরি হলেও সেই ব্যবস্থা নেই।

এ বিষয়ে রিভার ভিউ কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হলে কেউই ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। তবে জীবন ও জীবিকার উৎস ঝুঁকিতে থাকায় ওই মার্কেটের বাচ্চু অ্যান্ড সন্সের মালিক রাজু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে ফারজানা টাওয়ার, রিভার ভিউ কমপ্লেক্স, হাবিব কমপ্লেক্সসহ আরও দুটি মার্কেট একত্রে মিলে রিভার ভিউ কমপ্লেক্স। আগুন লাগলে তা নির্বাপণের জন্য কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখেনি মার্কেট কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয়, এখানে কোনো নিয়ম কানুন নেই। তারা তাদের মন মতো সব কিছু পরিচালনা করেন। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাতো নেই, অন্তত পানির যে ব্যবস্থা রাখা উচিত তাও নেই এখানে।

ফারজানা টাওয়ার দোকান মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শেখ গুফুর ফ্যাশনের মালিক আকবর শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে প্রচুর পরিমাণ গেঞ্জি মজুত রয়েছে। মার্কেটের বেজমেন্টে নিটিংয়ের সুতা ও ফেব্রিক্স মজুত রাখা হয়েছে। মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় কিছু দোকান রয়েছে, তবে এর উপরে শতাধিক হোসিয়ারি ও প্রিন্ট কারখানা রয়েছে। যেখানে অন্তত পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। এছাড়াও এই মার্কেটে আরও অন্তত দুই হাজার স্টাফ কাজ করছেন। তবে এই মার্কেটে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। আমরা মার্কেট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বার বার কথা বলেও কোনো সমাধান পাচ্ছি না। তারা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়, এক কথায় আমরা দোকান মালিকরা অবহেলিত।

দোকান মালিকরা চাইলে প্রতি দোকানে অন্তত একটি করে ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখতে পারতেন, এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন কখনো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ রকম কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে কিছু দোকানে গ্যাসের (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) বোতল আছে। কিন্তু এতে আগুন লাগলে কোনো কাজ হবে না। কারণ এখানে পুরো মার্কেটজুড়ে যেসব দোকান রয়েছে, তার প্রত্যেকটিতে সহজে দাহ্য জাতীয় পণ্য মজুত করা রয়েছে।

রিভার ভিউ কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আব্দুল বাতেনের কাছে মার্কেটের আগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে রাজি না। যার যার দোকানের সেফটি তার তার। এগুলো আমাদের দেখার বিষয় না, আগুন লাগলে আমি শুধু পানি দিব। সেই লাইন আমার করা আছে।

এমন পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে কিছুই বলতে চাইছে না নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। সংস্থাটির উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি ক্যামেরার সামনে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকের অনুমতি ছাড়া কথা বলা যাবে না বলে জানান। 

পরে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি কাউকে মিডিয়াতে কথা বলা যাবে না এমন নির্দেশনা দেইনি। আমি নারায়ণগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারকে বলে দিচ্ছি আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য। 

এর দুই দিন পর তার সঙ্গে নিতাইগঞ্জে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ ফায়ার স্টেশনে সরাসরি উপস্থিত হয়ে মহাপরিচালকের সঙ্গে আলাপচারিতার কল রেকর্ড শোনানোর পর বক্তব্য চাইলেও ক্যামেরার সামনে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি আব্দুল্লাহ্ আল আরেফীন।

তবে মৌখিকভাবে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের প্রধান এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা আমাদের মতো করে কাজ করছি। অগ্নি নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ প্রত্যেকটি মার্কেটে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে তিন থেকে চার বার সতর্ক করার পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী জেলায় মোট ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের সংখ্যা ৮৪টি বলে জানান তিনি।

আবির শিকদার/আরএআর