বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ এবং পূর্ণিমা তিথির প্রভাবে সৃষ্ট অস্বাভাবিক জোয়ারে তিন দিন ধরে প্লাবিত হচ্ছে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সমুদ্রে নিম্নচাপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সম্প্রতি উঁচু জোয়ারের পানিতে বন প্লাবিত হওয়ায় প্রাণীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গত আগস্ট মাসের পূর্ণিমার সময়ও টানা চার-পাঁচ দিন দুইবার করে প্লাবিত হয়েছিল সুন্দরবন। 

এদিকে সুন্দরবন বার বার প্লাবিত হলেও এখন পর্যন্ত বন্যপ্রাণীদের পানি থেকে রক্ষার কার্যক্রম পরিকল্পনাতেই আটকে আছে। 

এ বিষয়ে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দে বলেন, জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের দুবলা, কচিখালী, কটকা, নীলকমল, করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রসহ সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল  তলিয়ে যায়। এতে সুপেয় পানির পুকুরগুলো লবণাক্ত হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কোনো প্রাণীর মৃত্যুর খবর পাওয়া না গেলেও বিচরণ ক্ষেত্র পানিতে নিমজ্জিত থাকায় সমস্যায় পড়েছে বন্যপ্রাণীরা। সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মাটি দিয়ে উঁচু ঢিবি তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। সম্প্রতি জোয়ারে সুন্দরবন প্লাবিত হওয়ার কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। জোয়ারে ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার পানি প্রবেশ করায় বন্যপ্রাণী ও গাছ-পালার ক্ষতির শঙ্কার কথাও বলেন তিনি।

বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র করমজলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির বলেন, সম্প্রতি নদীতে পানি বাড়তে থাকায় সুন্দরবনের প্রাণীকূল হুমকির মুখে পড়ছে। এর মধ্যে শাবক বা বাচ্চারা অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও পূর্ণিমার প্রভাবে তিন দিন টানা বৃষ্টি হচ্ছে বাগেরহাটে। জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে জেলার বিভিন্ন উপজেলার অন্তত তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে ৫০০-৭০০ মৎস্য ঘের ও পুকুরের মাছ। কৃষি বিভাগ বলছে ঘেরের পাড়ে ও ক্ষেতে থাকা সবজির ক্ষতি হলেও, বৃষ্টিতে আমন ধানের উপকার হবে।

সদর উপজেলার গাওখালী এলাকার গণেশ প্রামাণিক নামে এক ব্যক্তি বলেন, স্বাভাবিক সময়ের জোয়ারেই আমাদের গ্রাম তলিয়ে যায়। আর এখন তো আরও বেশি উচ্চতার জোয়ার ঢুকছে গ্রামে। তিন দিন ধরে গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের রান্না বন্ধ রয়েছে। 

মাঝিডাঙ্গা আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা শহিদুল কাজী বলেন, ভৈরব নদের পাড় জুড়ে মাত্র ৫০০ মিটার বাঁধের অভাবে আশ্রয়ণ প্রকল্প ও স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি জোয়ারে ডুবতে হয়। সুপেয় পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে আমাদের।

পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা বেশি রয়েছে মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলায়। এ বিষয়ে বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলন বলেন, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলার অন্তত দুই হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে পুকুর ও মাছের ঘের। পানিবন্দি মানুষদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আজিজুর রহমান বলেন, গত দুই দিনে জেলায় ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ফকিরহাট উপজেলায় এক দিনে সর্বোচ্চ ৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি জমে মৌসুমী সবজিক্ষেতের কিছু ক্ষতি হয়েছে। পানি না নেমে গেলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। তবে বৃষ্টিতে রোপা আমন ধানের  উপকার হচ্ছে।

ভেসে যাওয়া মৎস্য ঘেরের সঠিক তালিকা  ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম রাসেল। 

জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ রোধে ৯৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানান বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ। তিনি জানান, চলতি অর্থ বছরে নদীর তীর সংরক্ষণের কাজ শুরু করা হবে। ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মোরেলগঞ্জ, রামপাল ও মোংলা উপজেলার বড় একটা অংশ নদীর পানি থেকে রেহাই পাবে। এছাড়াও বাগেরহাট সদরের জোয়ারের পানি ঠেকাতে জাইকার অর্থায়নে নদীতীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজ শিগগিরই শুরু হবে। 

তানজীম আহমেদ/আরএআর