কৈশোরেই পারিবারিক দৈন্যতায় বেহাত হয়ে গিয়েছিল জীবন। তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উদ্যোগে আশ্রয় হয় সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সেখানে তিন বছর সরকারি তত্ত্বাবধানে থেকে জীবনের অন্ধকার অধ্যায় মুছে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় তানজিলা আক্তার ও সৃষ্টি আক্তার। এবার আড়ম্বর আয়োজনে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আতিথেয়তায় বিয়ে দেওয়া হলো তাদের।

বর ওবায়দুল মৃধা ও রেজাউল সরদার। রেজাউল সরদারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তানজিলা আক্তার। আর ওবায়দুল মৃধার সঙ্গে সৃষ্টি আক্তার। এদের মধ্যে রেজাউল সরদার এবং সৃষ্টি আক্তার বাকপ্রতিবন্ধী।  

শনিবার (২৯ অক্টোবর) বরিশাল নগরীর উপকণ্ঠ জাগুয়া এলাকায় অবস্থিত সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে জাঁকজমক এই বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ে উপলক্ষে পুরো কেন্দ্র সজ্জিত হয় নতুন সাজে। আর সপ্তাহখানেক আগে থেকেই নিবাসীদের মধ্যে ব্যস্ততা বাড়ে বিয়ে নিয়ে।

বিয়েতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার আমিন উল আহসান, জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার, ভোলার জেলা প্রশাসক তৌফিক ইলাহি চৌধুরী, পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন, বরিশাল সামাজসেবা অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক শহিদুল ইসলাম, উপ-পরিচালক আল মামুন তালুকদার, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক আলমগীর হোসেন আলো, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু, সমাজসেবক মাহমুদুল হক খান মামুন, জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক সাজ্জাদ পারভেজসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন।  

 

সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, সৃষ্টি ও তানজিলা পথহারা ছিল। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। আজকে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ওরা পুনর্বাসিত হচ্ছে। এর সঙ্গে আনন্দের বিষয় হচ্ছে তিন বছর পরে ওদের বাকা-মাকে আমরা খুঁজে পেয়েছি। একটি জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে যেমন হয়, তেমনি সকল আয়োজন ছিল ওদের বিয়েতে। গায়ে হলুদ থেকে প্রতিটি পর্ব আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়েছে। এখানে ৩০০ আমন্ত্রিত অতিথি ছিল।

তিনি আরও বলেন, নবদম্পতি রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে দুটি ইজিবাইক পাচ্ছে। এছাড়া সেলাই মেশিন, সাংসারিক তৈজসপত্র ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ অর্থ উপহার দেওয়া হচ্ছে। দুই দম্পতির জন্য দোয়া কামনা করেন সাজ্জাদ পারভেজ। 

তানজিলা আক্তারের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার তুলাতলি এলাকায় আর সৃষ্টি আক্তারের বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার পলাশপুর এলাকায়। সৃষ্টি ও তানজিলা দুজনেই পুলিশের মাধ্যমে পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসেছিলেন। সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে পরা দুই কিশোরী সুস্থ জীবনে ফিরে আসার পর পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় সমাজসেবা দপ্তর। বরপক্ষের পরিবারের সম্মতিতে তিন লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে সম্পন্ন হয়।

সৃষ্টির আক্তারের স্বামী ওবায়দুল মৃধা উজিরপুর উপজেলার দক্ষিণ মোরাকাঠি গ্রামের খালেক মৃধার ছেলে। তানজিলার বর রেজাউল সরদার আগৈলঝাড়া উপজেলার নগরবাড়ি গ্রামের মহিউদ্দিন সরদারের ছেলে। তারা দুজনেই পেশায় ইজিবাইক চালক।

ওবায়দুল মৃধা বলেন, আমার পরিবারের সকলেই এখানে উপস্থিত আছেন। সৃষ্টিকে নিজে দেখেই পছন্দ করেছি। ও বাকপ্রতিবন্ধী। অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো নৈতিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব থেকেই আমি সৃষ্টিকে ঘরে তুলছি।

তানজিলা আক্তার বলেন, পুনর্বাসন কেন্দ্রে আমরা স্যারদের মেয়ের মতো আদর-যত্নে ছিলাম। আজকে আমাদের নতুন জীবনের সূচনা হচ্ছে। সকলে আমাদের নতুন জীবনে যেন সুখে-শান্তিতে থাকতে পারি তার জন্য দোয়া করবেন।

ওবায়দুল মৃধার মা বেবী নাজনিন বলেন, একজন অসহায় মেয়েকে আমি ঘরে পুত্রবধূ করে নিচ্ছি। আমি মনে করি অসহায়দের জন্য এভাবে যদি সকলে দাঁড়ায়, তাহলে সমাজটি সুন্দর হবে। কোনো মানুষ অবহেলায় থাকবে না। 

রেজাউল সরদারের বোন চায়না আক্তার বলেন, অসহায় একজন মেয়ের পাশে দাঁড়াতে পেরে আমাদের খুবই ভালো লাগছে। তাছাড়া বিয়ে উপলক্ষে এখানে যে সুন্দর আয়োজন হয়েছে, তা আমরা কখনো দেখিনি।

বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসেন বলেন, বরিশাল সমাজসেবা অধিদপ্তর আজকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়া দুজন মেয়ে নতুন জীবন পেল। তারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেল। 

বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের সবাই আমাদের মেয়ে। সেখানে থাকা আজ আমার দুই মেয়ের বিয়ে এতো জমকালোভাবে দিতে পেরেছি, এটাই আনন্দের। আর এ উৎসবমুখর পরিবেশের পেছনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম স্যার সার্বিক সহায়তা করেছেন। তার সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আমরা নবদম্পতিকে কর্মসংস্থানের জন্য দুটি অটোরিকশা দিয়েছি। এছাড়া বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন উল আহসান নির্দেশনায় বিয়েতে যা যা মেয়ের পরিবার থেকে দেওয়া প্রয়োজন তার সবকিছু যেমন লেপ, তোষক, ডিনারসেটসহ অনেক উপহার দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে মেয়েরা যাতে সেলাইয়ের কাজ করতে পারে, তাই তাদের দুজনকে দুটি সেলাই মেশিনও দিয়েছি। এছাড়া বরিশাল সদর উপজেলার চেয়ারম্যান সাইদুর রিন্টু, বিসিসির পরিচালক আলমগীর হোসেন আলো সমাজসেবক মাহমুদুল হক খান মামুন এই তিনজনে মিলে ৫০ হাজার টাকা উপহার দিয়েছেন, যা দুই দম্পতিকে ২৫ হাজার টাকা করে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, আজকে এই কেন্দ্রের দুজন মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, এতে আমি খুব খুশি। আমি আশা করবো সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন, তারা যেন সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের পাশে দাঁড়ান। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর