আমাদের ৯ বছরের সংসারে ৬ মাসের মেয়েটাই সব শেষে এসেছিল। আদর করে ওর বড় চাচি নাম রেখেছিল তামিমা। আমাদের আদরের সেই মেয়েটা সবার আগে চলে গেল। পুইড়া মইরা গেল। বিশ্বাস করেন ভাই, পোড়ার পর ওর হাত, পা, সারা গায়ের যে চেহারা হইছিল ওই চেহারা আমি সারা জীবনেও ভুলতে পারবো না। 

কথাগুলো বলছিলেন ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কোদালিয়া-শহীদনগর ইউনিয়নের বড় পাইককান্দি গ্রামের ইসমাইল হোসেন (২৭)। সোমবার তার বাড়িতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন।

গত ৭ নভেম্বর 'এয়ার কুল' কোম্পানির একটি কালো রংয়ের জালি ফ্যান বিস্ফোরণ হয়ে দগ্ধ হয় ছয় মাসের শিশু তামিমা। ৬ দিন রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার (১৩ নভেম্বর)  ভোরে মারা যায় শিশুটি।

চোখ মুছতে মুছতে তামিমার বাবা ইমাইল হোসেন বলেন, গতকাল রাতে চোখে এক ফোটাও ঘুম আসে নাই। বার বার চোখে ভাসছিল আমার মেয়ের পোড়া দেহ। ৬ মাসের বাচ্চা। ছোট্ট একটু দেহ। ওই দেহে আগুন লাগলে কী আর কিছু পুড়তে বাকি থাকে? আমার বয়স ২৭ বছর। জীবনে যতদিন বাইচা থাকব আমার তামিমার পোড়া দেহ এ চোখে ভাসবে।

কথা হয় তামিমার মা-বাবা-স্বজন-প্রতিবেশীদের সাথে। তামিমার বাবা সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ঘরে টেনে নেয়। বসতে দেয় সেই বিছানায় যেখানে শিশুটি আগুনে দগ্ধ হয়। বিছানায় বসে আছি। তামিমার মা রিমা বেগম (২৪) সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। স্বজন-প্রতিবেশীরা চারপাশ ঘিরে দাঁড়ানো। কান্নাকাটি করে মায়ের চোখ-মুখ ফুলে ভার হয়ে আছে। কয়েকবার ডাকার পরেও কথা বলতে চাচ্ছে না। আগ্রহ নাই। বোঝা যাচ্ছে তিনি কথা বলতে চান। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।
 
তবে এক সময় তার মুখ যেন খুলে যায়। চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে থোকেন মা রিমা বেগম (২৪)। বলেন, 'গত ৭টা দিন ৭০০ বছরের মতো যন্ত্রণায় কাটছে আমার। আমি কী কবো, সব জ্বালা কি কইয়া বোঝানো যায়? পৃথিবীর কেউ আমার এই দুঃখ বুঝবে, এই যন্ত্রণা কে ভোলাতে পারবে? মেয়েটা জীবনে আর আমার কোলজুড়ে থাকবে না, হাসবে না, খিদা লাগলে কানবে না, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসবে না।

রিমা বলেন, ও যখন কানত তখন আমি বুঝতাম ও দুধ খাবে। সেদিন দৌঁড়ায় আইসা যখন দেখলাম আগুনে পোড়া। কানতেছে আমি এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছি। হাসপাতালে নেওয়ার পরও ও কানছে দুধ খাওয়াইছি। ও কানলেই আমি বুঝছি, ও দুধ খাবে, ওর খিদা লাগছে। পুড়ে আঙ্গার মেয়েডারে দূর থেইকা চাইয়া চাইয়া দেখছি আর দোয়া করছি মাইয়াডা আমার কাছে আবার সুস্থ হয়া ফিরা আসুক। আইল না। এখন ও পোড়া নিথর দেহ নিয়া শুইয়া আছে ওই বড় পাইককান্দি গ্রামের কবরে।

কথাগুলো বলতে বলতে মায়ের চোখে ছলছল পানি। চোখ ভরে গেছে পানিতে। কাপড়ের আচল দিয়ে নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরল।বোঝা গেল, বড় ধরনের কান্নাকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করলেন। হয়তো ঘর ভর্তি মানুষ না থাকলে গলা ছেড়ে বুক ফাটা কান্না করতেন তিনি। চোখের পানি মুছে ভাবলেশহীন অবস্থায় নিজেকে সামলে আবার বলতে শুরু করলেন।

বললেন, সেদিন (৭ নভেম্বর) পাশে বাড়িতে গেছিলাম ফ্যানটা চালায় দিয়া। ওর শোয়ার সময় দুইপাশে দুইটা বালিশ দিয়া দিলে ভালো ঘুমাইতো। সেভাবেই দিয়া বাইরে গেছি। কাজ করছিলাম বাইরে। শব্দ শুনে ঘরে আসি। দেখি ধোয়া, আগুন। ততক্ষণে আমার তামিমার হাত, পা, বুক পুড়ে একাকার। ছোট বাচ্চা আমার। কী যন্ত্রণাই না সেদিন পাইছিল। কান্না থামায় নাই। সারাপথ কানছে। ঢাকায় যখন অ্যাম্বুলেন্সে নিছি সারাপথ কানছে।

তিনি বলেন, আপনারে আর কী কবো, আর কী শুনবেন কন? আমি আমার কথা আপনারে কইতে পারতেছি না। যদি আমার ভেতরডা আপনারে দেহাবার পারতাম তাইলে আপনি বুঝতেন। আমার তামিমা যেমন আগুনে পুড়ছে ওই আগুন ধাউ ধাউ কইরা আমার বুকে জ্বলতেছে। এইডা কাউর দেখাইতে পারতেছি না। এই আগুন থামবে না। কোনো দিনও না। কেউ থামাতে পারবে না।

একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছেন, চোখের সামনে দেখতেছি সেই ঘর, বিছানা, চৌকি, ওর জামা, ওর নানুর সেলানো কাথা। যে কাথায় ও শুইতো, যে জামা ও পড়ত সে সবই আছে, শুধু আমার জাদুধন তামিমা নাই।

তিনি বলেন, তামিমা দেখতে ওর ছোট ভাইয়ের মতো চেহারা পাইছিল। জমজ মনে হইত দুইজনকে।

ইসমাইলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, আর্থিকভাবে খুব একটা স্বচ্ছলও নয় পরিবারটি। দশ হাজার টাকা বেতনে ঢাকার 'লোটাস' নামের একটি কটন কারখানায় কাজ করেন ইসমাইল। দেড় শতাংশ বাড়ির ভেতর কোনো রকমে একটা টিনের ১৪ ফুট লম্বা, ৭ ফুট চওড়া মাটির ভিত দোচালা ঘর। সেখানে তাদের বসবাস। সামনে একটা পাটখড়ির রান্না ঘর। জায়গার অভাবে পুরান কাপড়ে ঘেরা একটি পায়খাো। ঘরের আসবাবপত্র বলতে আছে একটা ফ্রিজ আর একটা স্টিলের বাক্স।

শিশু তামিমার বাবা ইসমাইল বলেন, তিন-চার বছর আগে বাড়িতে কারেন্ট আনছি। ফ্যানটা কিনে আনছিলাম ২ বছর আগে নগরকান্দা বাজারের একটা ইলেকট্রনিকের দোকান থেকে ১২০০ টাকা দিয়ে। কে জানত একটু শান্তির জন্য আনা ফ্যানই আমার মেয়েরে চিরশান্তিতে পাঠাবে, কেড়ে নেবে, পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেবে!

৩ ভাই-বোনের মধ্যে তামিমা সবার ছোট ছিল। তার বড় ভাই ৭ বছরের তামিম হোসেন বড় পাইককান্দি মাদরাসায় মক্তব শ্রেণিতে পড়ে। পরের বোন ২ বছরের তাইমা।

৩ ভাই-বোনের মধ্যে ইসমাইল মেঝ। বাবা-মা বেঁচে আছেন। ৯ বছর আগে তিনি বিয়ে করেন ফুলসুতি গ্রামের ল্যাংড়ার মোড়ে।

তিনি জানান, তামিমার চিকিৎসার জন্য সত্তর হাজার টাকা ব্যয় হয়। এই টাকা তিনি ঋণ করে থেকে খরচ করেন। তিনি বলেন, কিস্তি উঠায় টাকা দিতে হবে। এটা না হলে এই বাড়ি বেইচা টাকা দিতে হবে। এই টাকা শোধ করার সক্ষমতা আমাদের নাই।

শিশু তামিমার দাদি রেনু বেগম ( ৫৭) বলেন, আমি সব সময় আমার এই নাতনিরে কোলে কোলে রাখতাম। আমারে ও ভালো চিনতো। যত কান্নাকাটি করুক আমি কোলে নিলে থাইমা যাইতো। আজ কতদিন হইল নাতনিডারে কোলে নিবার পারি না।

তামিমার নানি নাজমা বেগম (৫৩) বলেন, কয়েকদিন আগে মায়ের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে বেড়াইয়া আসছে তামিমা। এরপর যেদিন ওর দুর্ঘটনার খবর পাইলাম সেদিন নগরকান্দা হাসপাতালে আসতে আসতে ওরে ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমি আর ঢাকা যাই নাই। ভাবছিলাম সুস্থ হইয়া বাড়ি আসলে একবারেই দেখব। সে আশা আর পূরণ হইলো না। বাড়ি আসলো ঠিকই তবে সুস্থ হয়ে নয়, লাশ হয়ে।

প্রতিবেশী আবেজান বেগম (৭২) বলেন, এই মেয়েটারে কোলে কোলেই রাখতো সবাই। আমরাও কোলে নিতাম। কিন্তু সেদিন কীভাবে যে কী ঘইটা গেল বুঝবারই পারলাম না।

বড় পাইককান্দি গ্রামের বাসিন্দা মো. মিজানুর রহমান (৪৬) বলেন, গতকাল রোববার এই ঘটনা শুনলাম। আমাগো গ্রামে অনেকদিন আগে কারেন্ট আইছে। এমন ঘটনা তো শুনি নাই। এখন আমাদের তো ফ্যানের কাছে যাইতেই ভয় ভয় লাগে।

কোদালিয়া-শহীদনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খন্দকার জাকির হোসেন বলেন, ফ্যানের আগুনে পুড়ে শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় এলাকায় শোকের আবহ বিরাজ করছে। ঘটনাটি দুঃখজনক।

ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা বলেন, এই যুগে এসে প্রযুক্তি, বৈদ্যুতিক শক্তিকে পাশ কাটিয়ে জীবনযাপন করার উপায় নেই। আমাদেরকে প্রযুক্তির সুবিধা নিতে হবে আরও বেশি সতর্কতার সঙ্গে। কারণ, প্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিক শক্তি যেমন গতি দিতে পারে আবার পারে সর্বস্ব কেড়ে নিতে।

তিনি বলেন, আমাদের অনেককে দেখা যায়, কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায়। বিছানার সঙ্গে মিশিয়ে বৈদ্যুতিক সকেট সেট করে, নিন্মমানের তার ব্যবহার করে, পাওয়ার ব্যাংক বা মোবাইল ফুল চার্জ হয়ে যাওয়ার পরেও চার্জ দিয়ে রাখার প্রবণতা থাকে। এক্ষেত্রেও আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। সতর্কতার সঙ্গে এসব আধুনিক সভ্যতার সৃষ্টি ব্যবহার করলেই কেবল আমরা এর থেকে উপকৃত হবো।

এমএএস