রংপুর জেলায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ প্রায় ৮০ ভাগ ভবনে নেই অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা। সরকারি বিধিনিষেধ ও বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ ও অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিয়ম মানছেন না ভবন মালিকরা। এ কারণে দিন দিন বাড়ছে অগ্নি ঝুঁকি। বহুতল আবাসিক ভবনের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভবন, বিপণী বিতান, কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র। এ কারণে গত এক বছরে জেলায় ছোট-বড় ৪ হাজারের বেশি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৪১ জন।

মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সপ্তাহ’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের রংপুর বিভাগীয় উপ-পরিচালক জসিম উদ্দিন এ তথ্য জানান। 

তিনি বলেন, রংপুরের ৮০ ভাগ ভবনই অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে। কোনোভবনেই বিধিসম্মত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। আমরা এসব ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করছি। দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিস যে কাউকে সহযোগিতা করে। এটাই আমাদের কাজ। তবে বহুতল ভবন নির্মাণে অবশ্যই অগ্নি নির্বাপন সুবিধাসহ নিজস্ব নিরাপত্ত্বা ব্যবস্থা থাকতে হবে, এটি ভবন মালিকের দায়িত্ব। কিন্তু যদি কেউ বিনানুমতিতে বহুতল বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবন নির্মাণ করে এবং অগ্নি নির্বাপণ সুবিধাসহ অন্যান্য নিরাপত্ত্বা ব্যবস্থা না রাখে তাহলে তা আইনত অপরাধ।

রংপুর জেলার বেশির ভাগ সরকারি-বেসরকারি ভবনে কার্যকর অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় অগ্নি ঝুঁকি এখনো রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকগুলো অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। তবে গেল দুই-তিন বছরের তুলনায় সেই পরিসংখ্যান কিছুটা কমে এসেছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। আমরা সবসময় জনগণকে আইন মেনে চলার ব্যাপারে সচেতনতার সাথে উৎসাহিত করছি। আগের চেয়ে এখন ঝুঁকি কমে আসায় অগ্নি দুর্ঘটনাও কমছে। যারা আইন অমান্য করে অগ্নি ঝুঁকি বাড়াচ্ছে তাদের ব্যাপারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কছিরউদ্দিন হাসপাতাল, প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ রংপুর নগরীর বেশিরভাগ হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা অনুন্নত। হাসপাতালগুলোর মতো নগরীর বেশির ভাগ বিপণি বিতানও অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে। জেলা পরিষদ সুপার মার্কেট, কমিউনিটি সুপার মার্কেট, জাহাজ কোম্পানি শপিং কমপ্লেক্স, গোল্ডেন টাওয়ার, শাহ আমানত টাওয়ার, মিনি সুপার মার্কেট, সিটি বাজার, নবাবগঞ্জ বাজারসহ ছোট বড় বাণিজ্যিক ভবন ও মার্কেটগুলোতে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। এসব মার্কেট, বিপণী বিতান ও বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটলে মুহূর্তেই হতে পারে প্রাণহানি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুর জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটে প্রতিদিন হাজারো ক্রেতা আসে। এই মার্কেটের ভেতরে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য রয়েছে মাত্র তিনটি গেট। কিন্তু এতো বিপুল সংখ্যক ক্রেতা প্রতিদিন এই মার্কেটটিতে আসলেও অগ্নিকাণ্ড রোধে নেই কোনো ব্যবস্থা। জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটের মতোই চিত্র অন্য মার্কেটগুলোরও। আর বহুতল বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে রয়েছে বেসরকারি ব্যাংক, আবাসিক হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এগুলোর বেশির ভাগেই অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ও ফায়ার অ্যালার্ম নেই। ভবনগুলোর আশপাশে পুকুর না থাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে তা নিভানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

ভবন মালিকরা বিল্ডিং কোডসহ অন্যান্য নিয়ম না মানাতে অগ্নি ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন এসব দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

নিয়ম অমান্যকারীদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কাজ শুরু করছে ফায়ার সার্ভিস। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনসহ বিভিন্ন ভবন ও প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু শর্ত সাপেক্ষে নো অবজেক্টশন সার্টিফিকেট (এনওসি) দেওয়া হয়। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখাসহ অন্যান্য শর্ত বাস্তবায়ন না করলে অভিযান পরিচালনা করে ভবন মালিকদের সতর্ক করা হচ্ছে। তবে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর ব্যপারে বেশি গুরুত্বারোপ করছে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিস।

জসিম উদ্দিন আরও বলেন, রংপুর জেলায় গত এক বছরে অগ্নি দুর্ঘটনা সম্পর্কিত ৪ হাজারের বেশি ফোনকল রিসিভ করেছে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার দুর্ঘটনায় উপস্থিত থেকে আমাদের লোকজন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। অগ্নি দুর্ঘটনায় জেলায় এক বছরে ২৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া দুর্ঘটনাকবলিত প্রায় এক হাজার ৫০০ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।  

এদিকে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানান, যারা ভবন মালিক, তাদের বেশিরভাগই নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। তারা ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এমনকি আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে কী রকম ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, সেই পরামর্শও গ্রহণ করেননি। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে