শীতে গরিবের সম্বল কাজীপুরের ঝুট কাপড়ের কম্বল
সকালে মাঝারি কুয়াশা আর ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। আর এই শীতের রাতে কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাসে একটি গরম কাপড় সবার প্রয়োজন। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ এবং ফুটপাত, বস্তি ও রেলস্টেশনে থাকা ছিন্নমূল মানুষরা যখন কনকনে শীতে কাঁপতে থাকেন, সেই অসহায় ও দুস্থ মানুষদের কাছে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে ঝুট কাপড়ের তৈরি কম্বল। তাই শীতের শুরুতেই কম্বল তৈরিতে উপজেলার ৩০টি গ্রামে রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছেন কম্বল তৈরির কারিগররা।
যমুনা নদীর ভাঙনকবলিত সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের শিমুলদাইড় বাজার, ছালাভরা, বরশীভাঙ্গা, সাতকয়া, কুনকুনিয়া, পাইকরতলী, গাড়াবেড়, মাইজবাড়ি, চালিতা ডাঙ্গা, মেঘাই, শ্যামপুর, নয়াপাড়া, গাঁন্ধাইলসহ প্রায় ৩০টি গ্রামে গার্মেন্টসের ঝুটে নানা রং-বেরঙের বাহারি কম্বল তৈরি হচ্ছে। এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। বিভিন্ন ডিজাইনের তৈরি কম্বল জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের শীতকবলিত জেলার নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে যমুনা নদীর ভাঙনে বসতভিটা ও ফসলি জমিসহ সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন অনেকেই। তখন উপজেলার বড়শীভাঙ্গার সাইদুল হক নামের এক ব্যক্তি উপার্জনের পথ খুঁজতে চলে যান ঢাকার মিরপুরে। সেখানেই পরিচয় হয় এক ঝুট কাপড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তার কথায় ঝুট কাপড় কিনে চলে আসেন বাড়িতে। সেই ঝুট কাপড় সেলাই করে তৈরি করেন কম্বল। নিজের তৈরিকৃত কম্বল সাইকেলের পেছনে নিয়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রি শুরু করেন। কম্বল বিক্রির সেই টাকায় বদলাতে থাকে সাইদুলের জীবন। তার দেখাদেখি একই গ্রামের চাঁন মিয়া, হাজী জিয়াউল হক, মনির হোসেনসহ কয়েকজন শুরু করেন কম্বল তৈরির ব্যবসা। সেই থেকেই কাজীপুর উপজেলায় শুরু হয় কম্বল তৈরির কাজ। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ওই অঞ্চলের মানুষদের।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, ফ্ল্যাট লক মেশিনে ৪ জন শ্রমিক প্রতিদিন ৮শ থেকে ৯শ পিস কম্বল তৈরি করে থাকেন। একেকটি কম্বল তৈরিতে মজুরি বাবদ ২৫ থেকে ৩০ টাকা করে পেয়ে থাকেন কারিগররা। এছাড়া শীত মৌসুমে গৃহস্থালীর কাজের ফাঁকে নারীরাও কম্বল সেলাইয়ে ব্যস্ত থাকেন। এর ফলে সহজেই পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও বাড়তি আয় করে থাকেন।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষ করে শীতপ্রবণ এলাকা নাটোর, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, পাবনা, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, লালমনিরহাট, নীলফামারী, খুলনা, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যাপারী ও মহাজনরা এসে এই কম্বল ক্রয় করে থাকেন। এছাড়াও এই কম্বল গরিব-দুঃখীদের মাঝেও অনেকে বিতরণ করে থাকেন।
বড়শীভাঙ্গা গ্রামের কম্বল তৈরির কারিগর খালেদা খাতুন বলেন, স্বামী ও দুই সন্তানসহ চারজনের সংসার। মেয়ে স্থানীয় স্কুলে ৫ম শ্রেণিতে ও ছেলে ৩য় শ্রেণিতে পড়ে। নদীভাঙন এলাকায় পরিবারের পুরুষদের হাতে বেশিরভাগ সময়ই তেমন কাজ থাকে না। এ কারণে বছরজুড়ে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকতো। শীত মৌসুম এলে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি মায়ের কম্বল সেলাইয়ের কাজে সহযোগিতা করে। এতে অভাবকে আমরা দূর করতে সক্ষম হয়েছি।
খালেদার স্বামী ফ্ল্যাট লক মেশিনের কারিগর মোতাহার হোসেন জানান, শিমুলদাইড় বাজারে কম্বল তৈরির কাজ করেন তিনি। প্রতিদিন প্রায় ৮শ থেকে ৯শ টাকা আয় করেন। এতে তাদের সংসারের খরচ বাদে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। পাশাপাশি স্ত্রী কাজ করায় একসময়ের টানাটানির সংসারে এখন কিছুটা সঞ্চয়ও হচ্ছে।
শুধু মোতাহার হোসেনই নয়, এই গল্প কম্বল পল্লীর সহস্রাধিক পরিবারের। ১৫ হাজার পা-চালিত মেশিন ছাড়াও শিমুলদাইড় বাজারে রয়েছে প্রায় ৩শ যন্ত্রচালিত ফ্ল্যাট লক পাওয়ার মেশিন।
ফ্ল্যাট লক পাওয়ার মেশিনের আরেক কারিগর মজনু শেখ জানান, পাওয়ার মেশিনে প্রতিদিন ৪ জন কারিগর ৮শ থেকে ৯শ পিস কম্বল তৈরি করতে পারেন। এক্ষেত্রে কারিগররা একেকজন ৮শ থেকে ৯শ টাকা আয় করে থাকেন।
শিমুলদাইড় বাজারের ঝুট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শরিফুল ইসলাম জানান, ১৯৯৪ সালে প্রথমে কাজীপুরে গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় নিয়ে আসেন সাইদুল ইসলাম। তখন থেকেই ঝুট কাপড় দিয়ে কম্বল তৈরি শুরু করে স্থানীয়ভাবে বিক্রি করা শুরু হয়। বর্তমানে কম্বলের পাশাপাশি ছোট ছেলেমেয়েদের পোশাকসহ প্রায় ৫২টি পণ্য এই এলাকায় তৈরি হচ্ছে। শীতের এই মৌসুমে শিমুলদাইড় বাজার হতে ১৮ থেকে ২০ লাখ পিস কম্বল দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে।
শিমুলদাইড় বাজার কমিটির সভাপতি মো. আবু তাহের জানান, একসময় এই ব্যবসাটি স্থানীয় পর্যায়ে হলেও সময়ের ব্যবধানে এর পরিধি বেড়ে দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে। বর্তমানে স্থানীয় ব্যাপারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে নদী ভাঙনকবলিত মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অনেক উন্নতি হতো।
চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান মুকুল বলেন, শীত মৌসুমে শিমুলদাইড় বাজারে শত কোটি টাকার ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। কিন্তু হাতের কাছে ব্যাংক সুবিধা না থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা মহাজনদের টাকা লেনদেন নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়। তাছাড়া এখানের রাস্তাগুলো খুবই খারাপ মানের হওয়ায় যাতায়াতে অসুবিধা হচ্ছে। এ বিষয়গুলোর উন্নয়ন হলে ব্যবসার আরও প্রসার ঘটবে।
কাজীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সিরাজী বলেন, কাজীপুরে কম্বল তৈরির কাজ শুরু হওয়ায় এলাকার বেকারত্ব অনেকটাই দূর হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবসাটির প্রসার লাভে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি এমদাদুল হক এমদাদ বলেন, এই শিল্পকে কেন্দ্র করে কাজীপুরে গড়ে উঠেছে কম্বলের বাজার। দামে কম আর উন্নত মানের হওয়ায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা কম্বল কিনতে আসছেন। প্রতিদিন প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার কম্বল বিক্রয় হচ্ছে। সরকার ও দেশের বিত্তবানরা ত্রাণের জন্য দেশের বাইরে থেকে কম্বল আমদানি না করে এখান থেকে কিনলে আমাদের এই শিল্পটির আরও প্রসার হবে।
কাজিপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুখময় সরকার বলেন, এই শিল্পের প্রসারের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করবো। আশা করি একসময় এই শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে।
এমজেইউ