‘অনেক সময় না খেয়েও লেখাপড়া করেছি, আল্লাহ স্বপ্নপূরণ করেছেন’
বাইজিদ হোসাইন ও রিফাত হোসাইন
নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এবারের মাদারীপুরে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল একই পরিবারের দুই ভাই। ইচ্ছে ছিল, যে করেই হোক এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করার। অভাব অনটনের সংসারে সব বাধা পেরিয়ে সফলতা পেয়েছে তারা। সবাইকে তাক লাগিয়ে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে দুই ভাই। একজন বাইজিদ হোসাইন (বড়) আরেকজন রিফাত হোসাইন (ছোট)। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া কেরামতিয়া দাখিল মাদরাসা থেকে মানবিক বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে দুই ভাই।
বায়োজিদ ও রিফাত কালকিনি উপজেলার চর কয়ারিয়া গ্রামের নুরুউদ্দীন বেপারী ও রেনু বেগম দম্পত্তির ছেলে। তারা দুজনেই এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভালো ফলাফল করেছে। বাবা নুরুউদ্দীন পেশায় একজন গ্রাম পুলিশ। মা রেনু বেগম একজন গৃহিণী। সংসারে তাদের দুই ছেলে আর তারা স্বামী- স্ত্রী দুজন নিয়ে চারজন সদস্য। নুরুউদ্দীনের সামান্য বেতনের চাকরির পাশাপাশি কৃষিকাজ করেই ২ ছেলের লেখাপড়ার খরচ ও খাবারের যোগান দিতে হয়।
বিজ্ঞাপন
বাইজিদ হোসাইন ও রিফাত হোসাইনের স্থানীয় চাচাতো ভাই কবির খান জানান, তাদের পরিবার একেবারে হতদরিদ্র। অন্যের জমিতে তাদের বাবা কাজ করতো। নিজেদের কৃষি জমিও নেই। তার বাবা কখনও অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, কখনও আবার গ্রাম নিরাপত্তার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে যে টাকা পেতো সেই টাকায় কোনোমতে সংসার ও লেখাপড়া চলত।
বায়োজিদ হোসাইন বলেন, ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। কোনোদিন খাবার ঘরে ছিলো খেয়েছি, আবার কখনো না খেয়েই মাদরাসায় গিয়েছি। দুইভাই একই ক্লাসে পড়ায় খরচ বেশি বহন করতে হয়েছে বাবার। তার উপর অনেক চাপ পড়েছে। বাবা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। আজ আমরা ভালো ফলাফল করেছি। এখন সামনের দিনগুলোতে যেন এভাবেই ভালো ফলাফল করে এগোতে পারি আল্লাহর কাছে সেই দোয়া করি। আমি লেখাপড়া শেষ করে ভালো একটা চাকরি পেলে বাবা-মায়ের কষ্ট দূর হবে ইনশাআল্লাহ।
বিজ্ঞাপন
জানতে চাইলে রিফাত হোসাইন বলেন, সর্বপ্রথম আমি আল্লাহ তায়ালার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। আলহামদুলিল্লাহ আজ আমরা দুই ভাই গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। লেখাপড়ার জন্য অনেক কষ্ট করেছি ,মাইনসের খেতে কাম করেছি সে কামের টাকা দিয়ে বই-খাতা-কলম কিনছি। আমার সহপাঠীরা তাদের পরিবার থেকে যেমন চাইছে তেমন পাইছে। কিন্তু আমরা গরিব বলে আমাদের চাওয়া ছিল শুধু লেখাপড়া, আর কিছু না। কেননা বাবার সামান্য আয়ে আমাদের সংসার চলে। এই ভালো ফলাফল করার পেছনে আমাদের শিক্ষকদেরও অবদান আছে। আমার ইচ্ছে মানুষের মতো মানুষ হব। লেখাপাড়া শেষ করে আমি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা হব।
গৃহিনী মা রেনু বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানান, কোন দিন সকালে নাস্তা করার মতো খাবার ঘরে থাকেনি। বহুবার খেয়ে না খেয়ে স্কুলে যেতে হয়েছে। দুর্ভোগের মধ্যেও পড়াশোনা থেকে পিছপা হয়নি। আমার স্বামী গ্রাম-পুলিশ যা বেতন পায় তা থেকে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট তাই সে মাঠে কাজ করে, উপার্জনের টাকা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। পড়ালেখার জন্য বাড়তি কোনো টাকা দিতে পারেনি তার বাবা। তারা নিজেই টিউশনি করে লেখাপড়া করেছে। আর্থিক অসচ্ছলতায়, তাদের পড়ালেখা নিয়ে শঙ্কিত মা-বাবা। তবে নিজের ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায় তারা দুই ভাই।
দুই ছেলের সাফল্যে বাবা নুরুউদ্দীন বেপারী বলেন, অনেক কষ্ট করছি ছেলে দুইটাই জন্য। আমি আর ওগো মায়ে মিলে মাঠে কাজ করে পোলা দুইডারে লেহাপড়া করাইছি। গ্রাম পুলিশের চাকরিতে সাড়ে ৬ হাজার টাকার বেতন পাই, এইদিয়া একটা পোলার পড়ার খরচ ও হয় না। তাই পাশাপাশি কৃষি কাজ করি। আল্লায় আজ মুখের দিক তাকাইছে। ওরা অনেক ভালো ফল করছে।আল্লার কাছে আমার কোটি কোটি শুকরিয়া।
এ বিষয়ে কয়ারিয়া কেরামাতিয়া দাখিল মাদরাসা প্রধান শিক্ষক মাওলানা আবু সাঈদ বলেন, এই বছর আমাদের মাদরাসা থেকে ৩৮ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে ৩৬ জন পরীক্ষা দিয়েছে। ৩৬জন পরিক্ষার্থীর মধ্যে সবাই কৃতকার্য হয়েছে। বায়োজিদ আর রিফাত দুই ভাই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। তারা দুজনেই গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। তারা আমাদের মাদরাসার গর্ব। আর্থিক সংকটের কারণে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়। একটু সহায়তা পেলে তারা দুজনেই ভবিষ্যতে অনেক ভালো করবে।
কালকিনির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিংকি সাহা বলেন, দুই ভাইকে অবশ্যই সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।
শুধু এসএসসিতে নয়, অষ্টমতে শ্রেণি ও পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল দুই ভাই বাইজিদ হোসাইন ও রিফাত হোসাইন। বায়োজিদ আর রিফাতের স্বপ্ন এখন বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে দেশ ও জাতির সেবা করা।
রাকিব হাসান/আরকে